তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিশ্বাসই করে না
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমান সেনা ও বিমান বাহিনীর বহু মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছেন। অথচ এখন তার দল দাবি করে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের দল। কিন্তু ইতিহাস বলে তারা মুক্তিযুদ্ধেই বিশ্বাস করে না।
“ফেনী পাইলট হাই স্কুলে পড়ি তখন। হোস্টেলে থাকতাম। পুকুর পাড়ে ছিল কলেজ হোস্টেলটি। এক রোববার কলেজ হোস্টেলে আসেন একজন। আমাদেরও ডাকা হলো সেখানে। গিয়ে দেখি ইউনিফর্ম পরা এয়ারফোর্সের একজন অফিসার, নাম ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট খলিল উল্লাহ। এয়ারফোর্সের রিক্রুটিং অফিসার তিনি। সবার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘ডিফেন্সে বাঙালিদের যা কোটা আছে আমরা তার টেন পারসেন্টও পাই না।’ তিনি সবাইকে ডিফেন্সে যেতে উৎসাহিত করলেন।
হঠাৎ একটা ফাইটার এয়ারক্রাফট সাবরজান এফ-এইটি সিক্স কলেজের ওপর দিয়ে ফ্লাই করে চলে যায়। ‘রকেট যাচ্ছে’ বলেই সেটা দেখতে দৌড়ে মাঠে এসে দাঁড়াই আমরা। ততক্ষণে ফাইটারটা বহুদূর চলে গেছে। ফিরে যাচ্ছিলাম। খলিল উল্লাহ সাহেব এসে বললেন, ‘দাঁড়াও, ওটা আবার আসবে।’ ঠিকই তাই।
ফাইটারটি আবার এসে আকাশে ক্লাইম্ব করা, ড্রাইভ করা ও রোলিং করা দেখাল। মাঠে দাঁড়িয়ে অবাক দৃষ্টিতে আমরা তা দেখি। সে কি আনন্দ! শেষে খলিল উল্লাহ সাহেব বললেন, ‘এই যে রকেটটা দেখলে, চাইলে এটা তোমরাও চালাতে পারবা।’ তার ওই কথাটা মনে গেথে যায়।
এসএসসি পরীক্ষার পরই চলে যাই ঢাকায়। টার্গেট ছিল ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়া। খোঁজ-খবর নিচ্ছি। তখন রেজাল্টও বেরোল। কয়েক মার্কসের জন্য ফাস্ট ডিভিশন পাই না। ফলে ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়ার আশা শেষ। মনটা খুব খারাপ হয়। এক বড় ভাই চাকরি করতেন শাহবাগ হোটেলে। ওখানে তার সঙ্গেই থাকতাম। একদিন বেরোই জাদুঘর দেখতে। এশিয়াটিক সোসাইটি এখন যেখানে, তখন সেখানেই জাদুঘরটা ছিল। পাশেই ছিল এয়ারফোর্সের একটি রিক্রুটিং অফিস। সাইনবোর্ডটাতে চোখ পড়তেই খলিল উল্লাহ সাহেবের কথা মনে পড়ে।
কৌতূহলবশত অফিসটাতে ঢুকলাম। কোনো একটা পরীক্ষা চলছে। একজন বলল, ‘পরীক্ষা দিবা নাকি।’ কিছু না বুঝেই বললাম, দেব। ওরা কাগজ ও প্রশ্ন এনে দেয়। পরীক্ষা দিলাম। বিকেলের দিকে শুনি পাশ করে ফেলছি। খুব অবাক হই। পরে জানলাম এয়ারম্যান পোস্টে চাকরি হয়েছে। পোস্টটি সম্পর্কেও জানি না কিছু। ওই ভাইকে বলতেই তিনি খুব উৎসাহিত করলেন। তখন চিন্তাভাবনা না করেই জয়েন করে ফেলি, ১৯৬৪ সালের জুলাই মাসে। এয়ারম্যান নম্বর ছিল-৫৭৪১৬৫।”
পাকিস্তান এয়ারফোর্সে যোগদানের ঘটনাটি এভাবেই তুলে ধরেন বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী জয়নাল আবেদীন। এক সকালে তার বাড়িতে বসেই আলাপ চলে একাত্তরের নানা প্রসঙ্গে।
কাজী মোহাম্মদ আনিস ও আছিয়া খাতুনের ছোট সন্তান জয়নাল আবেদীন। বাড়ি নোয়াখালি জেলার সেনবাগ উপজেলার দেবীসেনপুর গ্রামে। তার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে সেখানেই।
আলাপচারিতায় ফিরে আসি জয়নাল আবেদীনের এয়ারফোর্স জীবনে। ওই সময় এয়ারফোর্সের ব্যারাকের একটি অজানা ঘটনার কথা তুলে ধরেন বীরপ্রতীক জয়নাল আবেদীন। তার ভাষায়, “সত্তরের নির্বাচনের আগের ঘটনা। হঠাৎ একটা অর্ডার আসে। অর্ডারটি এমন, ‘বেঙ্গলি উইল গেট ফিফটি পারসেন্ট রাইস অ্যান্ড ফিফটি পারসেন্ট চাপাতি, নন বেঙ্গলি ইজ নট ইট রাইস।’
মেসের দায়িত্বে ছিলেন এক স্কোয়াড্রন লিডার। স্টেশন কমান্ডার ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন। তারা ওইদিন উপস্থিত ছিলেন আমাদের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। সবাই দলবেধে মেসে গেলাম রাত আটটার দিকে। আমাদের মধ্যে সিনিয়র ছিলেন করপোরাল সিরাজী। বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। খাবারের জন্য তিনি প্রথম এগিয়ে যান। তাকে এক চামচ ভাত আর দুটি রুটি দেওয়া হলো। তিনি তখন বললেন, ‘নো, আই উইল টেক রাইস, নো চাপাতি।’ মেস অফিসার এগিয়ে এসে হেডকোয়ার্টারের লেটারটা দেখান। তখনই ক্ষেপে যান সিরাজী। শাউট করে বলেন, ‘ফাক ইওর ব্লাডি হেডকোয়ার্টার লেটার। আই ওয়ান্ট রাইস।’
পূর্ব পাকিস্তানে তখন তুমুল আন্দোলন চলছিল। শেখ মুজিব বলছেন, ‘আমার লোকেরা ভুট্টা খাবে না। আমরা ভাত খাব। আমরা ভুট্টা খাওয়ার জাত নই।’ আমরাও প্রতিবাদ করছি রুটি খাওয়াচ্ছে বলে, এমন খবর চলে গেলে শেখ মুজিবের আন্দোলন আরও এগোবে। আবার আমাদের শাস্তি দিলে ওই মেসেজও চলে যাবে বাইরে। তাই সিরাজীর প্রতিবাদের মুখে কিছু না বলেই গ্রুপ ক্যাপ্টেন সিদ্ধান্ত দিয়ে বলেন, ‘গিভ দেম রাইস।’ ভেতরে ভেতরে এমন নানা প্রতিবাদও হয়েছে তখন।”
জয়নাল আবেদীন ছুটি নেন একাত্তরের মার্চের ৩ তারিখ। কিন্তু ফ্লাইট না পাওয়ায় ৭ মার্চে ঢাকায় তেজগাঁও বিমানবন্দরে নামেন বিকেল চারটায়। অতঃপর চলে যান পুরান ঢাকায়, এক আত্মীয়ের বাড়িতে। এর পরের ঘটনা জানি জয়নাল আবেদীনের ভাষায়, “১৭ মার্চ পর্যন্ত ছিলাম ঢাকায়। এর পরই গ্রামে গিয়ে মানুষকে অর্গানাইজ করতে থাকলাম। সামরিক বাহিনীতে যারা অবসরে বা ছুটিতে এসেছেন তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ হতে থাকে। ২৫ মার্চের পর এলাকায় থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। তখন সীমান্ত পার হয়ে চলে যাই ভারতে, চোত্তাখোলা ক্যাম্পে। এমএনএ নুরুল হক সাহেব ছিলেন ওখানে। চোত্তাখোলা থেকে তার জিপেই চলে যাই বিলুনিয়ায়। সেখানে আর্মি অফিসার ছিলেন আব্দুর রব সাহেব। তিনি আমাকে আগরতলায় পাঠিয়ে দেন। এয়ারফোর্সের অনেককেই পাই সেখানে।
ওইসময় জিয়াউর রহমান তেলঢালাতে একটা ব্রিগেড করছিলেন। নাম ছিল ওয়ান আর্টি বিগ্রেড। ওটার নাম পরে হয় জেড ফোর্স। আমিও চলে যাই তেলঢালায়। ছিলাম বিগ্রেড হেডকোয়ার্টারেই, স্টোরের দায়িত্বে। জিয়াউর রহমানের ওই বিগ্রেডটিতে ছিল ফার্স্ট বেঙ্গল, থার্ড বেঙ্গল আর এইট বেঙ্গল। ৩১ অগাস্টে তিনি তিনটা ব্যাটেলিয়ানকে তিন জায়গায় যুদ্ধে পাঠান। ফার্স্ট বেঙ্গলকে কামালপুর, থার্ড বেঙ্গল বাহাদুরাবাদ ঘাট, এইট বেঙ্গল যায় নকশী বিওপিতে। কামালপুর ও নকশীতে ছিল পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটি। ফলে ফার্স্ট ও এইট বেঙ্গলের অধিকাংশ যোদ্ধাই ফিরে আসেনি।
তখন কান্নাকাটি করে সবাই। ওই যুদ্ধে জিয়াউর রহমান ব্যাটেলিয়ানের কমান্ডারও হয়েও যাননি। পাঠিয়েছেন মেজর হাফিজকে। যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতিও হয় ব্যাপক। এটা নিয়ে তখন ব্যাপক গুঞ্জন শুরু হয়। অনেক যোদ্ধাই বলেন, ‘আমাদের আর্টিলারি সাপোর্ট নাই। শক্তি নাই। তবুও প্রস্তুতিহীন এমন অপারেশনে পাঠানোটাই ছিল পাগলের প্রলাপ।’ কেউ কেউ জিয়াউর রহমানের ওপর সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদেরকে ইচ্ছে করে হত্যার জন্যই সেখানে পাঠানো হইছে’।”
এমন ঘটনা জয়নাল আবেদীনের মনেও দাগ কাটে। অনেকের মতো তিনিও প্রকাশ্যে এ নিয়ে কথা বলতেন। ফলে অগাস্টের প্রথম দিকে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ১১ নম্বর সেক্টরে, মাহেন্দগঞ্জে।
এর পরের ঘটনাগুলো এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বললেন যেভাবে, “ওখানে আমাকে অফিস অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভের কাজ দেওয়া হয় প্রথমে। মাহেন্দগঞ্জ ধানুয়া কামালপুরের খুব কাছাকাছি। কামালপুরে প্রায় প্রতিদিনই যুদ্ধ হতো। ওখানে ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন মাহফুজ নামের একজন। নিজেকে তিনি তাজউদ্দিন সাহেবের ভাগিনা পরিচয় দিতেন। একটা অপারেশনে তিনি শহিদ হন। তখন কামালপুর ক্যাম্প কমান্ডার করা হয় আমাকে। থাকতাম এক নম্বর বাঙ্কারের কাছে, চেয়ারম্যান বাড়ি বলে এক বাড়িতে। হেলালুজ্জামান ছিলেন আমার টুয়াইসি।
কামালপুরে আমাদের ক্যাম্পটা ছিল অ্যাডভান্স ক্যাম্প। পাকিস্তানি ঘাঁটিটা ছিল সেখান থেকে পশ্চিম দিকে বান রোডের পশ্চিমে ২ কিলোমিটার দূরে। ক্যাম্পটা দরকার ছিল আমাদের হেডকোয়ার্টার মাহেন্দগঞ্জকে রক্ষা করার জন্য। ওখানে আক্রমণ করতে গেলে আমাদের ক্যাম্পকে অতিক্রম করেই যেতে হবে।
সবার কাছে অস্ত্র ছিল একটা এসএলআর আর বিশ রাউন্ড গুলি। যারা কমান্ডার ছিলাম তাদের কাছে একটা স্টেনগান ও দুইটা ম্যাগজিন। প্রতি ম্যাগজিনে ২৮টা করে গুলি। এগুলোই ছিল সম্বল। আমার অধীনে বাঙ্কার ছিল আটটা। বানরোডের ওপর ছিল ট্রেঞ্চ। সেখানে অস্ত্রসহ একজন করে থাকত। বৃষ্টিতে ভিজে কাদা পানির মধ্যেই ডিউটি করতে হতো ট্রেঞ্চে।”
রণাঙ্গনে কয়েকটি অপারেশনের কথা শুনি বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীনের মুখে। অকপটে তিনি বলেন, “ক্যাম্পের ওপরে পাকিস্তানি সেনারা প্রায়ই আক্রমণ করত। একদিন ভোর ৫টার দিকে সব বাঙ্কার ও ট্রেঞ্চে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যালার্ট করে দিই। কারণ ওই সময়টাই ছিল আক্রমণের সময়। এরপর ৪ নম্বর বাঙ্কারে চলে আসি। ওটা ছিল কামালপুরের মুখোমুখি। অপেক্ষা করছিলাম। বেশ ঘন কুয়াশা। দেখলাম পাকিস্তানি সেনারা অ্যাডভান্স হচ্ছে লেলিং পজিশনে। বাঙ্কারে হেলালুজ্জামানসহ ৪-৫ জন। পাকিস্তানিরা দশ বারোজন। রেঞ্জের ভেতর আসতেই ফায়ারিং শুরু করে দিই। ডানে ৫ নম্বর বাঙ্কারসহ অন্যান্য বাঙ্কারে ছিল এলএমজি। সবগুলো গর্জে ওঠে। ফলে পাকিস্তানি সেনাদের কয়েকজন লুটিয়ে পড়ে।
মাঝেমধ্যে ইন্ডিয়ান আর্মির পরিকল্পনায় সামনে গিয়েও আক্রমণ করেছি। পাকিস্তানিদের ক্যাম্প আক্রমণ করলে পেছন দিয়ে হেডকোয়ার্টার থেকে ওদের রিইনফোর্সমেন্ট আসত। তাই একদিন ইন্ডিয়ান আর্মিদের সঙ্গে গোপনে কামালপুরের পেছনের দিকে অ্যাম্বুশ করি। ইন্ডিয়ান আর্মি প্রায়ই অপারেশনে নিয়ে যেত। এয়ারফোর্সে ছিলাম। উর্দু ও ইংরেজি বলতে পারতাম। আবার উর্দু-ইংরেজি মিশিয়ে যেটা ফৌজি ভাষা সেটাও বলতে পারতাম। এ কারণেই তারা আমাকে চাইত। মেজর সলো সিং ও ক্যাপ্টেন গোখলে আমাকে খুব পছন্দ করতেন।
সাধারণত রাস্তার এক পাশে অ্যাম্বুশ করতে হয়। কিন্তু ওইদিন আমরা করলাম দুপাশে। ইন্ডিয়ান আর্মির প্রায় প্রত্যেকের কাছে বেলচা থাকত। তারা যেখানে যেত সেটা দিয়ে গর্ত করে পজিশন নিত। গর্তের ভেতর সাপ যেমন তেমনি গর্তের ভেতর যোদ্ধাও বিপদজনক। আমাদের একটি কোম্পানি কামালপুর আক্রমণ করে উত্তর দিক থেকে। আমরা দক্ষিণ দিকে কামালপুর-বকশিগঞ্জ রোডে অ্যাম্বুশ করে অপেক্ষায় আছি। ওদের রিইনফোর্সমেন্ট আসবে বকশিগঞ্জ থেকে, এ পথ দিয়েই। ওরা রেঞ্জের ভেতর আসতেই ফায়ার শুরু হয়। ওদের তখন পালানোরও পথ ছিল না। কারণ রাস্তার ডানেও আমরা, বামেও। অনেক পাকিস্তানি সেনা মারা যায় ওইদিন।
আর একবার বর্ডার থেকে অনেক ভেতরের দিকে গেলাম, দিনের বেলায়। ইন্ডিয়ান এক মেজরও ছিলেন সঙ্গে। পাকিস্তানিরা কামালাপুর ক্যাম্প থেকে বের হতো না। কিন্তু অস্ত্র নিয়ে আমরা বেরোতাম। দেশ তো আমাদের, জনগণও। ওই মেজর পানি খেতে চাইলেন। এক বাড়িতে গেলাম। পানি চাইতেই ওরা সঙ্গে সঙ্গে খেতে দিল মুড়ির মোয়া। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি খুব আন্তরিক ছিল সবাই। সাধারণ মানুষের এমন মনোভাব দেখে ওই ইন্ডিয়ান মেজর বেশ অবাক হন। অতঃপর বলেন, ‘তোমাদের দেশ দ্রুতই স্বাধীন হবে। কারণ তোমাদের জনগণ তোমাদের সঙ্গে আছে’।”
কর্নেল তাহের যে অপারেশনে রক্তাক্ত হন সেখানে উপস্থিত ছিলেন বীরপ্রতীক জয়নাল আবেদীনও।
কী ঘটেছিল ওইদিন?
রক্তাক্ত ওই দিনটির কথা এই বীরপ্রতীক বলেন ঠিক এভাবে, “নভেম্বরের ১৩ তারিখ। সম্মিলিতভাবে কামালপুর আক্রমণ করি। আমি গেলাম পাকিস্তানিদের ঘাঁটির উত্তর-পূর্ব দিকে। রাত আড়াইটার দিকে ওখানে পজিশন নিই। উদ্দেশ্য পাকিস্তানি ক্যাম্পে আক্রমণ ও দখল করা। কর্নেল তাহের আমাকে একটি কোম্পানি নিয়ে ওইদিক দিয়ে আক্রমণের নির্দেশ দেন। বানরোডের ভেতরে ঢুকি না। মাঝে মাঝে গুলি চলছে। ইন্ডিয়ান আর্মি আর্টিলারি সার্পোট দেয়। সকালে ওদের বাঙ্কার দেখা যাচ্ছিল। তখন সিদ্ধান্ত নিই ওদের বাঙ্কারে গিয়ে আক্রমণের। আমার কাছে ওয়্যারলেস ছিল। বললাম শেলিং বন্ধ করেন সামনে এগিয়ে বাঙ্কার আক্রমণ করব। কর্নেল তাহের বললেন, ‘তোমরা অপেক্ষা করো আমরা আসতেছি।’
১৪ নভেম্বর, সকাল তখন ৬টা হবে। একটু কুয়াশা পড়েছে। তিনি আসলেন। একটা মেশিন গান হাতে দিলে তিনি সেটা নিয়ে বানরোডের ওপরে বসেন। কিছুটা নিচে উনাকে ঘিরে আছি আমরা। হঠাৎ একটা আওয়াজ হলো। দেখলাম তার বাম পা কোনোরকমে ঝুলে আছে। অ্যান্টি-পারসোনাল মাইনের আঘাত ছিল ওটা। তখনও রক্ত বের হয়নি। মেশিনগানটা হাতে দিয়ে কর্নেল তাহের শুধু বললেন, ‘আবেদীন, আমার পা-টা চলে গেল। হাসি মুখ তখনও। দৃঢ়ভাবে বললেন, ‘তোমরা এগিয়ে যাও। কামালপুর আমাদের দখল করতেই হবে।’ গ্রামের একটা কুড়েঘরের কাঠের দরজা খুলে এনে সেটাকে স্টেচার বানিয়ে তাঁকে শুইয়ে পাঠিয়ে দিলাম। তার ছোট ভাই বাহার, বেলাল, সাঈদও সঙ্গে যায়। আমরা তখনও রণাঙ্গনে থাকি।
পরে কি কামালপুর দখল করতে পেরেছিলেন?
‘ওইদিন পারিনি। ওটা ছিল পাকিস্তানিদের শক্তিশালী ঘাঁটি। নভেম্বরের শেষ দিকেই আমরা কামালপুরে পাকিস্তানি ক্যাম্পটার পেছনের দিক ঘিরে রাখি। সেক্টর কমান্ডার তখন ক্যাপ্টেন আজিজ। কিন্তু অপারেশনটি আমরা করি ইন্ডিয়ান আর্মির নির্দেশে। ওখানে অবস্থান নেওয়ায় পাকিস্তানি সেনাদের সার্পোট আসতে পারে না। রেশন আসাও বন্ধ হয়ে যায়। গোলাবারুদ কমতে থাকে। তখন কোনঠাসা হয়ে পড়ে। আমরা তাদের ওপর গুলি করছি। কিন্তু ওরা ক্যাম্প থেকে বের হচ্ছে না। ইন্ডিয়ান আর্মি শেলিংও করল। কিন্তু ওদের কোনো সাড়া নেই।
৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। ওদের ক্যাম্পে একটা চিঠি পাঠানো হলো। লেখা ছিল এমন, ‘তোমাদেরকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। পালানোর পথ নাই। সারেন্ডার করো।’ মুক্তিযোদ্ধা বশিরকে দিয়ে ওই চিঠিটি পাঠান ব্রিগেডিয়ার ক্লিয়ার। কিন্তু বশির গিয়ে আর ফিরে আসে না। সবার মধ্যে তখন উত্তেজনা। মুক্তিযোদ্ধারা চাচ্ছে ভেতরে ঢুকতে। পরে আরও একটি চিঠি দিয়ে পাঠানো হয় আনিসুল হক সজ্জুকে। সন্ধ্যার দিকে সবাই বের হয়ে আসে। সঙ্গে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন আহসান মালিক ও তার নেতৃত্বে শতাধিক পাকিস্তানি সেনা। ওরা সারেন্ডার করে বান রোডের ওপরে, ইন্ডিয়ান আর্মির কাছে।”
বীরপ্রতীক জয়নাল আবেদীন এরপর এক কোম্পানি ফোর্স নিয়ে বাহাদুরবাদ ঘাট হয়ে দেওয়ানগঞ্জ এবং ডিসেম্বরের ১০ তারিখ জামালপুর মুক্ত করেন। সেখানে পিটিআই স্কুলে স্বাধীন দেশের পতাকা ওড়ান এবং শত শত মুক্তিযোদ্ধা কণ্ঠ আকাশে তুলে গায়, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি…’। পরে টাঙ্গাইল হয়ে তিনি চলে যান ময়মনসিংহে।
স্বাধীনতা লাভের পর এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্ট বিভাগে চাকরি পান। ট্রেনিং শেষে তার পোস্টিং হয় সিলেট পেপার মিল ছাতকে। সেখানে সিনিয়র পার্সেজ ম্যানেজার এবং পরে কর্মাশিয়াল ম্যানেজার হন। পরবর্তীতে চলে যান পুলিশ বিভাগে। সর্বশেষ ডিআইজি পদমর্যাদা পেয়ে তিনি অবসর নেন, ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে।
বঙ্গবন্ধুর হত্যা পরের একটি ঘটনা তুলে ধরেন বীরপ্রতীক জয়নাল আবেদীন। ঠিক এভাবে, “আমি তখন সিলেট পেপার মিলে। ১৫ অগাস্ট খুব ভোরে উঠে দেখি মানুষের জটলা। বের হয়ে অফিসে আসি। কী ঘটেছে সেটা জানার জন্য দোতলায় যাই। আর্মির একজন রিটায়ার্ড ক্যাপ্টেন ছিলেন। নাম মোসলেহ উদ্দিন। তার রুমে ঢুকতেই দেখলাম খুশিতে প্রায় লাফাচ্ছে। কী হয়েছে? তিনি বললেন, ‘শেখ মুজিবকে তো হত্যা করা হইছে।’ শুনে প্রায় স্থির হয়ে যাই। পরে রেডিওতে জানলাম খবরটি। আমি মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর ঠিক মেনে নিতে পারি না।
মোসলেহ উদ্দিন ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। একাত্তরে তার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সুযোগ ছিল। তিনি তা না করে পাকিস্তানি আর্মির সঙ্গেই ছিলেন। আমাদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতা লাভের পর তাকে আর্মি থেকে বের করে দেওয়া হয়। পরে তিনি চাকরি নেন পেপার মিলে। মোসলে উদ্দিনের মতো ২৭ জনকে পরে জিয়াউর রহমান আবারও সরকারি চাকরিতে ফিরিয়ে আনে। তার মধ্যে ২৫ জনই চাকরি পায় পুলিশ বিভাগে। আর্মির দুই বছরের সিনিয়রিটিও দেওয়া হয় তাদের। পরে পুলিশের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে চলে যায় তারা।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমান সেনা ও বিমান বাহিনীর বহু মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছেন। অথচ এখন তার দল দাবি করে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের দল। কিন্তু ইতিহাস বলে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিশ্বাসই করে না।”
এই বীরপ্রতীক দুঃখ প্রকাশ করে অকপটে বলেন, “এখনও আমাদের মধ্যে পাকিস্তানপ্রীতি খুব গভীর। ভারত-পাকিস্তান খেলা হলে পাকিস্তানকে সার্পোট দেয় এদেশের হাজার হাজার মানুষ। ভারত জীবন দিয়ে আমাদেরকে স্বাধীনতা আনতে সহযোগিতা করেছে। অথচ তারা আমাদের কাছে শত্রু। পাকিস্তান মুসলিম দেশ হয়েও একাত্তরে এদেশের লাখো মানুষকে হত্যা করেছে। অথচ মুসলিম অজুহাতে স্বাধীন দেশে তাদেরই সপোর্ট করছি আমরা। এর চেয়ে কষ্টের বিষয় আর কি আছে!”
আগামী প্রজন্মের প্রতি পাহাড়সম আশা বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী জয়নাল আবেদীন বীরপ্রতীকের। তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন, “আমরা আগে বাঙালি পরে মুসলমান। এটা তোমরা অন্তরে ধারণ করো। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বাঁচিয়ে রেখো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করো দেশটাকে।”
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৪ অক্টোবর ২০২৩
© 2024, https:.