কালের ভাস্কর সেলিম আল দীন
লেখক হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৬৮ সালে, কবি আহসান হাবিব সম্পাদিত দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার মাধ্যমে। আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের নিয়ে লেখা তাঁর বাংলা প্রবন্ধ নিগ্রো সাহিত্য ছাপা হয় ওই পত্রিকায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠা সেলিম আল দীনের হাত ধরেই। ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সেলিম আল দীন ১৯৮১-৮২ সালে নাট্য নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফকে সাথী করে গড়ে তোলেন গ্রাম থিয়েটার। তিনি গানকে বলতেন, কথাসুর ৷ ১৯৯৯ সালের শেষের দিকে কয়েকজনকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ছোট্ট একটা গানের দল ৷ নাম দিয়েছিলেন, ‘কহনকথা’ ৷
সেলিম আল দীন একজন প্রখ্যাত নাট্যকার ও গবেষক। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তিনি নাটকের আঙ্গিক ও ভাষার উপর গবেষণা করেছেন। বাংলা নাটকের শিকড় সন্ধানী এ নাট্যকার ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যের বিষয় ও আঙ্গিক নিজ নাট্যে প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলা নাটকের আপন বৈশিষ্টকে তুলে ধরেছেন।
নাট্যকার সেলিম আল দীন জন্মেছিলেন ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট ফেনীর সোনাগাজী থানার সেনেরখিল গ্রামে৷ মফিজউদ্দিন আহমেদ ও ফিরোজা খাতুনের তৃতীয় সন্তান তিনি৷ শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ফেনী, চট্টগ্রাম, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও রংপুরের বিভিন্ন স্থানে৷ বাবার চাকুরির সূত্রে এসব জায়গার বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করেছেন তিনি ৷
সেলিম আল দীন ১৯৬৪ সালে ফেনীর সেনেরখিলের মঙ্গলকান্দি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন ৷ ১৯৬৬ সালে ফেনী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন ৷ ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন৷ দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে গিয়ে ভর্তি হন টাঙ্গাইলের করোটিয়ায় সাদত কলেজে৷ সেখান থেকে স্নাতক পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন ৷ ১৯৯৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন সেলিম আল দীন ৷
ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার প্রতি ছিল তাঁর চরম ঝোঁক। লেখক হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৬৮ সালে, কবি আহসান হাবিব সম্পাদিত দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার মাধ্যমে। আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের নিয়ে লেখা তাঁর বাংলা প্রবন্ধ নিগ্রো সাহিত্য ছাপা হয় ওই পত্রিকায়।
বিজ্ঞাপনী সংস্থা বিটপীতে কপি রাইটার হিসেবে চাকরি জীবন শুরু করলেও পরে সারাজীবন শিক্ষকতাই করেছেন ৷ ১৯৭৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং আমৃত্যু এই বিশ্ববিদ্যালয়েই ছিলেন তিনি ৷ ওই বছরই বেগমজাদী মেহেরুন্নেসার সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠা সেলিম আল দীনের হাত ধরেই। ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সেলিম আল দীন ১৯৮১-৮২ সালে নাট্য নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফকে সাথী করে গড়ে তোলেন গ্রাম থিয়েটার।
তিনি গান লিখতেন আশির দশকের মাঝমাঝি সময় থেকে ৷ নাটকের গান তো ছিলই ৷ পাশাপাশি আরও অনেক গান লিখেছিলেন ৷ তিনি গানকে বলতেন, কথাসুর ৷ ১৯৯৯ সালের শেষের দিকে কয়েকজনকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ছোট্ট একটা গানের দল ৷ নাম দিয়েছিলেন, ‘কহনকথা’ ৷
সেলিম আল দীন যেসব কাজ করেছেন সেগুলির মূলে আছে পাশ্চাত্য শিল্পধারাকে চ্যালেঞ্জ করা এবং এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজস্ব শিল্প সৃষ্টি করে তা অনুশীলন করা ৷ তিনি বিশ্বাস করতেন, পরের অনুকরণ করে কখনও নিজস্বতা অর্জন করা যায় না৷ খুব জোরের সঙ্গে বারবার বলেছেন, ‘অন্যের বসন কখনও নিজের হয় না৷ হয় না সেটা নিজের ভূষণ ৷
তাঁর প্রথম রেডিও নাটক বিপরীত তমসায় ১৯৬৯ সালে এবং টেলিভিশন নাটক আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় লিব্রিয়াম (পরিবর্তিত নাম ঘুম নেই) প্রচারিত হয় ১৯৭০ সালে। তিনি শুধু নাটক রচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি, বাংলা ভাষার একমাত্র নাট্য বিষয়ক কোষগ্রন্থ বাংলা নাট্যকোষ সংগ্রহ, সংকলন, প্রণয়ন ও সম্পাদনা করেছেন। তাঁর রচিত হরগজ নাটকটি সুয়েডীয় ভাষায় অনূদিত হয় এবং এ নাটকটি ভারতের রঙ্গকর্মী নাট্যদল হিন্দি ভাষায় মঞ্চায়ন করেছে।
প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘সর্প বিষয়ক গল্প ও অন্যান্য নাটক’ (১৯৭৩)৷ তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক-গ্রন্থ: ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’ (১৯৭৫), ‘বাসন’ (১৯৮৫) ‘মুনতাসির’, ‘শকুনত্মলা’, ‘কিত্তনখোলা’ (১৯৮৬), ‘কেরামতমঙ্গল’ (১৯৮৮), ‘যৈবতী কন্যার মন’ (১৯৯৩), ‘চাকা’ (১৯৯১), ‘হরগজ’ (১৯৯২), ‘প্রাচ্য’ (২০০০), ‘হাতহদাই’ (১৯৯৭), ‘নিমজ্জন’ (২০০২), ‘ধাবমান’, ‘স্বর্ণবোয়াল’ (২০০৭), ‘পুত্র’, ‘স্বপ্ন রজনীগণ’ ও ‘ঊষা উত্সব’৷ রেডিও টেলিভিশনে প্রযোজিত নাটক: ‘বিপরীত তমসায়’ (রেডিও পাকিস্তান, ১৯৬৯), ‘ঘুম নেই’ (পাকিস্তান টেলিভিশন, ১৯৭০), ‘রক্তের আঙ্গুরলতা’ (রেডিও বাংলাদেশ ও বিটিভি), ‘অশ্রুত গান্ধার’ (বিটিভি, ১৯৭৫), ‘শেকড় কাঁদে জলকণার জন্য’ (বিটিভি ১৯৭৭), ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’ (আয়না সিরিজ, বিটিভি ১৯৮২-৮৩), ‘গ্রন্থিকগণ কহে’ (বিটিভি ১৯৯০-৯১), ‘ছায়া শিকারী’ (বিটিভি ১৯৯৪-৯৫), ‘রঙের মানুষ’ (এনটিভি ২০০০-২০০৩), ‘নকশীপাড়ের মানুষেরা’ (এনটিভি, ২০০০), ‘কীত্তনখোলা’ (আকাশবাণী কোলকাতা, ১৯৮৫) ৷
গবেষণাধর্মী নির্দেশনা: ‘মহুয়া’ (ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে, ১৯৯০), ‘দেওয়ানা মদিনা’ (ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে, ১৯৯২), ‘একটি মারমা রূপকথা’ (১৯৯৩), ‘কাঁদো নদী কাঁদো’, ‘মেঘনাদ বধ’ (অভিষেক নামপর্ব)৷ অন্যান্য: ‘চাকা’ নাটক থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ১৯৯৪, ‘কীত্তনখোলা’ নাটক থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ২০০০ সালে৷ ‘একাত্তরের যীশু’ চলচ্চিত্রের সংলাপ রচনা করেন ১৯৯৪ সালে ৷
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও সম্মাননা: বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৪; ঋষিজ কর্তৃক প্রদত্ত সংবর্ধনা, ১৯৮৫; কথক সাহিত্য পুরস্কার, ১৩৯০ বঙ্গাব্দ; একুশে পদক, ২০০৭; জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১৯৯৩; অন্য থিয়েটার (কলকাতা কর্তৃক প্রদত্ত সংবর্ধনা); নান্দিকার পুরস্কার (আকাদেমি মঞ্চ কলকাতা) ১৯৯৪; শ্রেষ্ঠ টেলিভিশন নাট্যকার, ১৯৯৪; খালেকদাদ সাহিত্য পুরস্কার; জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (একাত্তরের যীশু, শ্রেষ্ঠ সংলাপ) ১৯৯৪; মুনীর চৌধুরী সম্মাননা, ২০০৫ ৷
কালের ভাস্কর সেলিম আল দীন ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারী মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্য ও ছবি : সংগৃহীত
© 2012 – 2018, https:.