মুক্তিযুদ্ধ

দেশ স্বাধীন করেছি কিন্তু শত্রু মুক্ত করে যাইনি!

“আমাদের পরিবারটা ছিল বড়। সাত ভাই ও তিন বোনের সংসার। পঞ্চম আমি। আব্বা ছিলেন এইচএমভি ডাক্তার। কলকাতায় পড়াশোনা করেছেন। হাসান হাফিজুর রহমানের ছোটভাই ডা. ফারুক। তিনি ছিলেন আব্বার ঘণিষ্ঠ বন্ধু। দুইজনই ভাল ডাক্তার। চিকিৎসা করতেন গ্রামেই। বাড়িতে কেউ অসুস্থ হলে ফারুক চাচা এসে ট্রিটমেন্ট করতেন। আর উনাদের বাড়িতে কেউ অসুস্থ হলে আব্বা যেতেন। প্রসবের সময় ব্যাথা কমাতে হোমিওপ্যাথির একটা ভাল ওষুধ দিতেন আব্বা। দূর-দূরান্ত থেকে বহু লোক এসে সে ওষুধ নিত। এলাকায় বেশ নাম ডাক ছিল তার।

আমাদের জমি-জমা ছিল অনেক, একটা দাগেই ছাব্বিশ বিঘা। বর্গা বাড়ি থেকে ধান আসতো ঘোড়ার গাড়িতে। এক সময় ওই জমিগুলো চলে যায় যমুনার ভাঙনে। আব্বার পক্ষে তখন সংসার চালানো খুবই কঠিন হয়ে পড়ে।

বাড়ি থেকে প্রায় সাড়ে তিন মাইল দূরে ছিল বাহাদুরাবাদঘাট। ওখানে আব্বা একটা চেম্বার করেন। উনি ফিরতেন অনেক রাতে। এক রাতে টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছিল। অন্ধকার পথ পেরিয়ে আব্বা আসেন বাড়িতে। এসেই মাকে বললেন- ‘সাপে কাটছে আমারে।’ মা দ্রুত পা-টা বেধে দেন। আব্বা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। ওই দৃশ্য দেখে বুকের ভেতরটা ধুপ করে ওঠে। পাশের গ্রাম থেকে আনা হয় ওজা। রাতভর চেষ্টা করে সকালে বিষ নামে আব্বার শরীর থেকে। ভেবেছিলাম তিনি মরেই যাবেন। ওই রাতটা কাটে নানা শংকায়। এখনও মনে হলে বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে।”

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট হতে সম্মাননা নিচ্ছেন মিজানুর রহমান খান বীরপ্রতীক

বাল্যকালের নানা স্মৃতিচারণ এভাবেই তুলে ধরেন মুক্তিযোদ্ধা মো.মিজানুর রহমান খান বীরপ্রতীক। এক বিকেলে তার বাড়িতে বসেই কথা চলে। আলাপ হয় যুদ্ধদিনের নানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে। মিজানুর রহমান খানের পিতার নাম ডা. রিয়াজুল ইসলাম খান আর মা নুরুন্নাহার খানম। বাড়ি জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার কুলকান্দি গ্রামে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি কুলকান্দি টিকে প্রাইমারি স্কুলে। ১৯৬৯ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন গোঠাইল হাই স্কুল থেকে। এরপর চলে আসেন জয়দেবপুরে, বড় ভাই নজরুল ইসলাম খানের কাছে। ইন্টারমেডিয়েটে ভর্তি হন ভাওয়াল বদরে আলম কলেজে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ফাস্ট ইয়ারের ছাত্র।

স্কুল জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, “রওশন আলম খান, কামরুল হাসান খান, হারুন-অর-রশিদ খান, সুরুজ্জামান, বদরুল, আন্জু এরাই ছিল বন্ধু। পড়াশোনায় খুব ভাল ছিলাম না। তবে শান্ত ছিলাম। ফুটবল, দারিয়াবান্দা ও হাডুডু খেলতাম। বাইন নদী আর ছোট নদীতে মাছ ধরছি বরসি আর ঠেলা ঝাল দিয়ে।”

“তখন টিচারদেরকে যমের মতো ভয় পেতাম। টিকে প্রাইমারী স্কুলের হেড মাস্টার ছিলেন আব্দুল গফুর খান। সম্পর্কে বড় মামা। এক বাড়িতেই থাকতাম। উনি খড়ম পায়ে হাঁটতেন। খট খট শব্দ হতো। আমাদের বাড়িটা ছিল বেশ লম্বা। বাড়ির এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত হাঁটতেন তিনি। যতক্ষণ খড়মের শব্দ হতো ততক্ষণ পড়তে হতো। তখন নতুন বই ছিল না। অন্যের পুরাতন বই-ই পড়তাম আমরা। আগের টিচাররা জ্ঞান রাখতেন। সেই জ্ঞান ছাত্রদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়াটাকেও দায়িত্ব মনে করতেন। এখন এটা নেই। অনেক অপ্রয়োজনীয় জিনিস শিশুদের মাথায় এখন ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি। সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি…।’ কত সুন্দর কথা। এমন উপদেশমূলক কবিতা তো এখন শিশুরা শিখছে না।”

মিজানুর রহমান খান রাজনৈতিক জ্ঞান লাভ করেন তার বড় নজরুল ইসলাম খানের কাছে। তিনি জয়দেবপুর মেশিন টুল্স ফ্যাক্টরিতে চাকুরি করতেন। তখন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতিও ছিলেন। ফলে কলেজে ভর্তি হয়েই মিজানুর রহমানও যুক্ত হন ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে। ভাওয়াল বদরে আলম কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের কোষাধক্ষ্য ছিলেন। ওই সময় ছাত্র আন্দোলনে নানা মিছিল মিটিংয়েও যুক্ত থাকতেন তিনি।

১৯৭০ সালে নির্বাচন হলো। আওয়ামী লীগ জয় লাভও করল। সবাই তখন খুশি। বাঙালিরাই এবার দেশ চালাবে। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা দিতে টালবাহান শুরু করে। ফলে সারাদেশে আন্দোলন দানা বাধতে থাকে। অ্যাসেম্বলি ডাকা হয় ৩ মার্চ ১৯৭১ তারিখে।

এরপর কী হলো?

সে ইতিহাস শুনি মিজানুর রহমানের জবানিতে। তার ভাষায়-

মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমান খানের বীরপ্রতীক খেতাবের সনদ

“১ মার্চ ১৯৭১। কলেজ থেকে ফিরছি। জয়দেবপুর রেল ক্রসিংয়ের পাশে একটা পুরানা বটগাছ ছিল। ওখানে এসেই হতভম্ব হই। মানুষজন নেই। দোকানপাট সব বন্ধ। একজন বলল, তিন তারিখের অধিবেশন স্থগিত করা হয়েছে। পুরা দেশ অগ্নিস্ফূলিংগের মতো ঝলে উঠে। কল-কারখানা, হাট-বাজার, স্কুল কলেজ বন্ধ হয়ে যায়।”

“ভাওয়াল রাজবাড়ির পাশেই ছাত্র ইউনিয়নের মিটিং হয়। প্রস্তাব উঠে ট্রেনিং করার, মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং। একজন বাঙালি নন-কমিশনড অফিসারের সাথে কথা হয়। পরদিনই উনি লিচু বাগানে বাঁশের লাঠি আর ডামি রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং করানো শুরু করেন। ট্রেনিং করি আমরা ২০-২৫ জন। কাঞ্চন, হাতেম, আতিক, সিরাজ প্রমুখও ছিল। এরপর খবর আসে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের। ছাত্র ইউনিয়ন থেকে সিদ্ধান্ত হয় রেসকোর্স ময়দানে যাওয়ার।”

“মার্চের প্রথমেই জয়দেবপুরে সর্বদলীয় মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। যার হাইকমান্ডে ছিলেন হাবিবুল্লাহ মাষ্টার, এম এ মোতালেব, ডা. মনিন্দ্র নাথ গোস্বামী। পরিষদের সেক্রেটারি ছিলেন আ ক ম মোজাম্মেল হক (বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক মন্ত্রী)। মিজানুর রহমানের বড় ভাই নজরুল ইসলাম খান ছিলেন কোষাধক্ষ্য। সদস্য ছিলেন- হারুনুর রশিদ, আবুল হোসেন প্রমুখ। তখন এই সর্বদলীয় মুক্তিসংগ্রাম পরিষদই জয়দেবপুরের আন্দোলনটা নিয়ন্ত্রণ করেছিল।”

বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়তেই ঢাকার আকাশে প্রতিদিনই বহু হেলিকপ্টার টহল দিতে থাকে। কিছু ঘটবে। লোকমুখে শুনেছি ওরা ট্যাংক আর কামান নিয়ে প্রস্তুত। কী হবে দেশে? বড় ভাই রেসকোর্স ময়দানে মিজানুর রহমানকে যেতে দিলেন না। কিন্তু উনি নিজে গেলেন।
মিজানুর বলেন-‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে নজরুল ভাই আসলেন অনেক রাতে। আমরা তো টেনশনে। উনি এসেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনাগুলো বললেন। পরদিনই আমাকে পাঠিয়ে দিলেন গ্রামে, কুলকান্দিতে। ওখানে আনসার অ্যাডজুটেন্ট ছিলেন মুসা চাচা। উনার মাধ্যমে বিশ-পচিশজন বাঁশের লাঠি নিয়ে ট্রেনিং শুরু করি, মিয়াবাড়ির মাঠে।”

“গ্রামে ফকা দুলাভাই ইপিআরের সুবেদার ছিলেন। উনার একটা রেডিও ছিল। সেখান থেকেই খবর শুনতাম। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় গণহত্যা শুরু করে আর্মিরা। পরদিন গ্রামের যুবক বয়সীদের নিয়ে হাসান ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা বাহাদুরাবাদ ঘাটে গিয়ে মিছিল করি কালো পতাকা নিয়ে। ২৮ মার্চ তারিখে নজরুল ভাই চলে আসেন জয়দেবপুর থেকে। উনিও যুক্ত হন আমাদের সঙ্গে।”

মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ে গেলেন কীভাবে-জানাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমান খান বীরপ্রতীক

“জামালপুরে আর্মি চলে আসে এপ্র্রিলের মাঝামাঝিতে। তখনই যুবকরা ভারতে চলে যেতে থাকে। আঠাশ তারিখ চলে যান নজরুল ভাইও। কিন্তু আব্বা আমাকে যেতে দেন না।”

আপনাদের ওখানে আর্মি গেল কবে?

“৯ জুলাই। রাতের বেলা। বাবা এসে ডেকে বলেন- ‘গুলির শব্দ শুনলাম। তোমরা সাবধানে থেকো।’ তার কথা বিশ্বাস করলাম না। ভোরে ডেকে তুলে ছোটবোন। বলে- ‘গিয়া দেখ স্কুলের ওখানে কতজনকে মেরে ফেলে রাখছে।’ আমরা ছুটে গেলাম। টিকে স্কুলের পেছন দিক দিয়ে একটি রোড চলে গেছে বাহাদুরাবাদঘাটের দিকে। ওই রাস্তার পাশে ছোটনদীর পাড়ে পড়ে আছে মানুষের লাশ। দেখি সব আমাদের আত্মীয়। ফারুক চাচা, তার ভাই কাউসার চাচা, শাহজাহান চাচা, দোকানদার ছিল হামিদ ভাই, মেম্বার মুরাদ আলী খান, তসর আলী খান প্রমুখ। এরা একেবারেই নিরীহ ছিল।”

“কয়েকদিন আগে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল নৌকায় ছোটনদী দিয়ে এসে টিকে স্কুলে উঠে। গ্রামের লোকেরা তখন কেউ মুরগি দিয়ে, চাল দিয়ে তাদের সহযোগিতা করে। ওরা খেয়েই চলে যায়। এই খবর রাজাকার আর শান্তিকমিটির লোকেরা দিয়ে আসে পাকিস্তানিদের কাছে। ওরা ৯ জুলাই রাতে গ্রামে হানা দেয়। গুলি করে হত্যা করে নিরীহ নিরাপরাধ ১১জনকে। ভরসা ভাইসহ ১২জনকে নদীর পাড়ে দাঁড় করিয়েছিল। ফায়ারের আগেই ভরসা ভাই পড়ে যাওয়ায় প্রাণে বেঁচে যায়।”

“একদিন পরেই মামাতো ভাই হারুনুর রশিদ খান হিরুকে জামালপুর থেকে আর্মিরা ধরে নিয়ে যায়। এ খবর আমাদের মধ্যে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। আব্বা তখন অনুমতি দেন ভারতে যাওয়ার।”

ট্রেনিং নিলেন কোথায়?

মিজানুর রহমান বলেন, ‘১৫ জুলাই ১৯৭১। হাসানুজ্জামান খানকে নিয়ে বাড়ি ছাড়ি। পরনে ছিল আব্বার একটা টুপি আর পাঞ্জাবি। প্রথমে দেওয়ানগঞ্জের চিকাজানি গিয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠি। ওরা বলে আজ তো যেতে পারবা না। বৃহস্পতিবারে সূর্যনগর বাজারে হাট। হাটে যারা যায় তাদের সঙ্গে চলে যেতে পারবা। আমরা চারদিন ওখানে থাকি। হাটের দিন সন্ধ্যায় সূর্যনগর বাজারে গিয়ে শুনি ওই এলাকায় মিলিটারিরা কম্বিং অপারেশন চালিয়েছে। ভয়ে কেউ আমাদের জায়গা দেয় না। একজনকে বলে রাত কাটিয়ে পরদিনই চলে যাই ভারতের মাহেন্দ্রগঞ্জে।”

“ওখানে থানার সামনে ট্রেনিংয়ের জন্য নাম লেখাই। ২৭ জুলাই রিক্রুটের জন্য লোক আসে। আমিসহ ৪০০-৪৫০জনকে ওরা নিল ট্রেনিংয়ে। চারটা কোম্পানি করা হয়। আমরা ছিলাম বদি কোম্পানিতে। কমান্ডার মাদারগঞ্জের বদি। সবমিলিয়ে ছিলাম একশোর ওপরে। ১২জন করে একটি গ্রুপ করে দেওয়া হয়। বিভিন্ন সরঞ্জাম নিয়ে একটা পাহাড়ে উঠে আমরা তাঁবু গাঁড়ি। ওখানেই চলে ট্রেনিং। ট্রেনিংয়ে বিএসএফের ধন বাহাদুর আর ক্যাপ্টেন নিয়োগীর কথা এখনও মনে পড়ে।”

যুুদ্ধ করেন কোথায় কোথায়?

“ট্রেনিং চলার সময়েই ছোট ছোট অপারেশনে আমাদের পাঠানো হত। ট্রেনিং শেষে এগার নম্বর সেক্টরের ধানুয়া কামালপুরে অপারেশন করেছি। সেখানে ১৮টি অ্যাটাকের ১৬টিতেই অংশ নিয়েছিলাম।”

কয়েকটি অপারেশনের কথা তুলেন ধরেন এই বীরপ্রতীক। তাঁর ভাষায়,

“অগাস্টের ২ বা ৩ তারিখের ঘটনা। ট্রেনিং করছি। হঠাৎ খবর আসে ধানুয়া কামালপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা পেট্রোল পার্টিকে পাকিস্তানি আর্মিরা ঘিরে ফেলেছে। সবাই অস্ত্র হাতে ছুটে যাই। পাকিস্তানিদের ক্যাম্পের দিকে তাক করে গোলাগুলি শুরু করি। ওরা তো ট্রেন্ড সৈন্য। আমাদের দিকে তখন মর্টার শেল মারা শুরু করে। বামপাশে ছিল আমানুল্লাহ কবির (বীর বিক্রম)। আমার সহযোদ্ধা ও বন্ধু। হঠাৎ একটা মর্টারের স্প্রিন্টার পেটে লেগে তার নাড়িভুড়ি বেড়িয়ে যায়। সবকিছু ঘটছিল চোখের সামনে। আমরা কিছুই করতে পারিনি! এক সময় মর্টারের মুখে আমরাও পিছু হটি। নয়পাড়া গ্রাম হয়ে ফিরে আসি ক্যাম্পে। সকালেও একসঙ্গে নাস্তা করেছি আমানুল্লাহ কবিরের সঙ্গে। আর বিকেলেই সে বেঁচে নেই। ঠিক মেনে নিতে পারছিলাম না। অকাতরে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের জন্য এভাবেই জীবন দিয়েছিল একাত্তরে। জীবনের মায়াও তখন ছিল না।”

১৪ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখে আহত কর্নেল তাহেরকে রেসকিউ করার ইতিহাস জানাচ্ছেন মিজানুর রহমান খান বীরপ্রতীক

“মাহেন্দ্রগঞ্জ ছিল এগার নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টার। কর্নেল তাহের কমান্ডার। ওই সময় বদি কোম্পানি থেকে চলে আসি হেলাল কোম্পানিতে। ১৪ নভেম্বর তারিখে কর্নেল তাহেরকে রেসকিউও করেছিলাম। ওইদিন ছিল তার জন্মদিন। তার আগের দিন ঘোষণা করলেন- ‘কাল কামালপুর ক্যাম্প দখল করব।’ আমিসহ ১০জনকে ডেকে নিয়ে ওরিয়েন্টেশন দিলেন তিনি। নয়াপাড়া গ্রামের শেষ অংশে অপেক্ষা করবে। আমি আসলে তোমাদের নিয়ে কামালপুর ক্যাম্পে ঢুকব। ওরা সারেন্ডার করলে ওদের আর্মসের ট্রিগার খুলে পানিতে ফেলে দিবে। যা পরে ব্যবহার করা যাবে। আমরা অপেক্ষা করছি। এদিকে প্রচণ্ড গোলাগুলি চলছে। তিনদিক দিয়ে ওদের ঘিরে রেখেছে মুক্তিযোদ্ধারা। চু চু করে গুলি চলছিল। ওই দৃশ্য এখন কল্পনা করতেও ভয় লাগে। কখন মারা যাব তার নিশ্চয়তাও ছিল না।”

“কর্নেল তাহের এসেই বলেন ‘মুভ’। নয়াপাড়া গ্রামের শেষ প্রান্তে গিয়ে ক্রলিং করতে থাকি। ধানি জমি। কিন্তু কর্কশ মাটি। নোম্যান্স ল্যান্ড পাড় হয়ে পাকিস্তানি বান রোডে এসেই পজিশনে চলে যাই। তখন তুমুল গোলাগুলি চলে। মাত্র একশো গজ সামনে ছিল ওদের বাংকার। হঠাৎ দেখি কর্নেল তাহের গড়িয়ে নিচে পড়ে আছে। তার বাম পা রক্তে ভেজা। উনি একটা লাঠি ব্যবহার করতেন। হাতে ছিল একটা ওয়ারল্যাস। ও দুটো তুলে নিলাম। লেফটেনেন্ট মিজান, সুজা ভাইসহ আরও মুক্তিযোদ্ধারা আসলেন। আমরা কর্নেল তাহেরকে তুলে নিই। দূর থেকে পাকিস্তানিরা মর্টার মারে। মেশিন গানের গুলিও চলছেই। তার ভেতরেই আমরা ছুটে চলি।”

“উনাকে নয়াপাড়া গ্রামে নিয়ে একটা দরজার পাল্লায় শুইয়ে দিই প্রথম। অতঃপর নিয়ে যাই ইন্ডিয়ান আর্মিদের কন্ট্রোল রুমে। কর্নেল তাহের নিজের চিন্তা করছিলেন না। পা দিয়ে রক্ত পড়ছে। তবুও বলছেন, ‘তোরা আমারে রাখ। কামালপুর দখল করতে যা।’ এমন যোদ্ধা আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি।”

যে দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করলেন স্বপ্নের সে দেশ কি পেয়েছেন?

প্রশ্ন শুনে মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমান বলেন, “দেশ অবশ্যই পেয়েছি। আজ বাংলাদেশ বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের পতাকা সারাবিশ্বে উড়ছে। এটাই তো আমাদের অ্যাচিভমেন্ট। আজ পদ্মাসেতু করছি, বড় বড় বিল্ডিং, বড় বড় চুক্তি করছি বিদেশিদের সঙ্গে। এই দেশ স্বাধীন না হলে তো এটা সম্ভব ছিল না।”

মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে ভাগ হওয়াকে দুভার্গ্যজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, “মুক্তিযোদ্ধা তো মুক্তিযোদ্ধাই। খেতাব পাইছি এটা কোন বড় ব্যাপার না। আমি যে দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করতে পেরেছি এটাই বড় কথা। মূলত রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সুবিধার জন্যই মুক্তিযোদ্ধাদের দলীয়করণ করেছে। এটা হয়েছে সব সরকারের আমলেই।”

স্বাধীনতা লাভের এতো বছর পরেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা কেন বাড়ে?

তিনি বলেন, “ভুয়ারাই ভুয়া বাড়াইছে। অমুক্তিযোদ্ধারাই তাদের দল বাড়াতে অমুক্তিযোদ্ধাদের সনদ দিয়েছে। তা না হলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কীভাবে ভুয়া সনদ পায়! অসৎ লোকেরাই এটা করেছে।”

স্বাধীন দেশে রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের উত্থান প্রসঙ্গে এই বীরপ্রতীক বলেন, ‘এটা মুক্তিযোদ্ধাদেরই ব্যর্থতা। আমরা দেশ স্বাধীন করেছি কিন্তু শত্রু মুক্ত করে যাইনি। যুদ্ধের পরেই রাজাকারদের শেষ করে দেওয়া উচিত ছিল। আমরা সেটা করিনি। রাজাকারদের একটা তালিকাও হয়নি। ফলে রাজনীতির ছত্রছায়ায় এরা প্রভাবশালী হয়েছে।”

দেশ কেমন চলছে?

“অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর কন্যা দেশের অনেক উন্নতি করছেন। কিন্তু তার আমলে বিচারবহির্ভুত হত্যা ও অপমৃত্যুগুলো দেখলে খারাপ লাগে। গণতন্ত্র, কথা বলার স্বাধীনতা এগুলোর জন্যই তো আমরা পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করলাম। সেগুলো ঠিক রাখাও সরকারের দায়িত্ব।”

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিজানুর রহমান খান বীরপ্রতীক

স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাল লাগার কথা জানাতে এই সূর্যসন্তান অকপটে তুলে ধরেন নিজের অনুভূতি। তার ভাষায়, “প্রজন্মকে দেখলে মন ভাল হয়ে যায়। এই প্রজন্মের হয়েও আপনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভাবছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করছেন। এমন অনেক তরুণই আছে। যারা নিরপেক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করা চেষ্টা করছে। আমি মনে করি এটা দেশের জন্য অনেক বড় একটি বিষয়। কারণ দেশের সত্যিকারের ইতিহাসই সম্ভাবনার পথ দেখাবে।”

খারাপ লাগে কখন?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে এই বীর বলেন, “‘সমাজে অন্যায়টা প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। এটা খারাপ লাগে। একজন অন্যায় পথে দুটি বিল্ডিংয়ের মালিক হলেই সে সফল ব্যক্তি। আর যে সততার সঙ্গে কাজ করছেন। সে হয়তো কষ্ট করেই চলছেন। অথচ সমাজে তাকে নিয়ে কোনো কথা হয় না। সকল প্রশংসা চলে যায় ওই বিল্ডিংয়ের মালিকের কাছেই। এটা বদলাতে হবে। কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। অন্যায় আর দুর্নীতিও বন্ধ করতে হবে।”

নানা সমস্যা থাকলেও দেশ এগোচ্ছে। দেশটা আরও উন্নত হবে প্রজন্মের হাত ধরেই। তাই চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে তাদের উদ্দেশে বীরপ্রতীক মিজানুর রহমান বলেন শেষ কথাটি, “তোমরা কথা ও কাজে সৎ থেকো। দেশটাকে মায়ের মতো ভালবেসো। লাল-সবুজের পতাকাকে তুলে ধরো সারাবিশ্বে।”

সংক্ষিপ্ত তথ্য
নাম : মুক্তিযোদ্ধা মো. মিজানুর রহমান খান বীরপ্রতীক।
ট্রেনিং করেন : ভারতের মাহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পে।
যুদ্ধ করেছেন : এগার নম্বর সেক্টরের অধীনে ধানুয়া কামালপুরের ১৬টি অ্যাটাকেই অংশ নিয়েছিলেন। ১৪ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখে কর্নেল তাহেরকে রেসকিউও করেছিলেন তিনি।

ছবি ভিডিও : সালেক খোকন

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ৩০ জুন ২০১৯

© 2019, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button