চৈতবিসিমা, সিরুয়া বিসুয়া

রাত বাড়তেই ফিরতি পথ ধরি। কানে তখনো ভেসে আসছে আদিবাসী গান আর ঢোলের ছন্দ। আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে বিভিন্ন জাতির এমন লোকজ উৎসব। উৎসবে দলগত নৃত্য, গান, বিশ্বাসের নানা আচার আর প্রাণখোলা আড্ডায় তারা ভুলে যায় তাদের চিরচেনা দুঃখ আর হিংসা-বিদ্বেষের বিভেদটুকু।
বৈশাখে নানা বিশ্বাসের মানুষের উৎসব দেখব বলেই গিয়েছিলাম দিনাজপুরে। এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে চলে যাই বিরল উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম বহবলদীঘিতে। ২০টি ভুনজার পরিবারের বাস এখানে। একটি বাড়িতে ঢুকে দেখি তুলসীগাছের পাশে মাটিতে বেশ কয়েকটি সিঁদুর ফোঁটা দেওয়া। বেশ কিছু ফুলও পড়ে আছে।
বোঝা যায় এক দিন আগেই হয়েছে পূজার আনুষ্ঠানিকতা। মহত বা গোত্রপ্রধানের খোঁজ করতেই ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধের দেখা মেলে। হাসিমুখে পিঁড়ি টেনে বসতে দেন তিনি। নাম তাঁর বাতাসু ভুনজার। জানালেন, বৈশাখ উদযাপনের অংশ হিসেবেই গোত্রের সবাই আজ দল বেঁধে বেরিয়েছেন শিকারে। তাঁরা এখনো পূর্বপুরুষদের রীতি অনুসারে চৈত্র মাসের শেষদিন আর বৈশাখ মাসের প্রথম দিনকে বিশেষ পূজা আর আচারের মাধ্যমে পালন করে থাকেন। তাঁদের ভাষায় এটি ‘চৈতবিসিমা’ উৎসব। এই উৎসবের অংশ হিসেবে চৈত্র মাসের শেষ দিন তাঁরা বাসন্তী পূজাও করে থাকেন।
কেন এমন পূজা করতে হয়? বাতাসুর উত্তর ‘বাপ-দাদারা পূজেছে, তাই পূজি।
তিনি বললেন, একসময় চিকিৎসার জন্য এই অঞ্চলে কোনো ডাক্তার ছিল না। তখন ডায়রিয়া আর বসন্ত রোগে মারা যেত শত শত মানুষ। এই রোগ থেকে মুক্তির জন্য এই পূজা করা হতো বলেই এর নামকরণ হয়েছে ‘বাসন্তী পূজা’।
এ সময় মাটির ঘটিতে আমপাতা, কলা, নারকেল, ধূপ আর চার ফোঁটা সিঁদুর দিয়ে ঠাকুরের উদ্দেশে পূজা দেওয়া হয়। কেউ কেউ এই দিনেই বলি দেয় মানতের হাঁস, মুরগি কিংবা পাঁঠা। এর আগে চৈত্রের শেষ শুক্রবার তারা উপোস থাকে। উদ্দেশ্য সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভ ও নিজেদের রুজি বৃদ্ধি। বাতাসু ভুনজারের বিশ্বাস, প্রতি চৈত্রে এই পূজার কারণেই তাঁদের গোত্রে এখন আর ডায়রিয়া কিংবা বসন্ত রোগের প্রাদুর্ভাব হয় না।
বৈশাখের সকালে ভুনজাররা সবাই মিলে পোনতা (পান্তা ভাত) খান। পূর্বপুরুষের আমল থেকেই চৈতবিসিমার অংশ হিসেবে তাঁরা কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ দিয়ে সেরে নেন পান্তা খাওয়া। তাদের বিশ্বাস, পান্তা খেলে সারা বছর গায়ে রোদ লাগলেও তাঁরা কষ্ট পান না। তা ছাড়া পান্তার পানি তাঁদের শরীরকে ঠাণ্ডা রাখে।
ওই দিনই তাঁরা তীর-ধনুক আর কোদাল নিয়ে দল বেঁধে শিকারে বের হয়। সন্ধ্যায় ঠাকুরকে ভক্তি দিয়ে শিকারগুলো দিয়ে রান্না হয় খিচরি (খিচুড়ি)। রাতভর চলে আনন্দফুর্তি আর প্রিয় পানীয় হাড়িয়া খাওয়া। তাদের সংস্কৃতিতে খেমটা আর ঝুমুর নাচ এখনো আদি ও অকৃত্রিম হয়ে আছে।
মধ্য দুপুর তখন। ভুনজারদের পাড়া থেকে বের হয়ে কালিয়াগঞ্জের পথ ধরি। আঁকাবাঁকা মেঠোপথ পার হতেই বিশাল শালবন ঠেকে। বনের ভেতরেই মুণ্ডা পাহানদের একটি পাড়া। আমাদের দেখে এগিয়ে আসেন সবুজ পাহান। জানালেন, বৈশাখের রীতি অনুসারে তাঁরা ভাতের সঙ্গে খেয়েছেন ১২ ভাজা অর্থাৎ ১২ পদের তরকারি। ভোরে আনন্দ নিয়ে খেয়েছেন পান্তা ভাত। আর সন্ধ্যায় চলবে নাচ-গানের আসর।
সবুজের দাদা শ্যামল পাহান। বয়স সত্তরের মতো। বড় একটি গাছের ছায়ায় বসা। কথায় কথায় জানতে চাইলাম—বৈশাখে কেন পান্তা খান? তিনি মুচকি হাসেন। উত্তরে সুর করে গান ধরেন—
‘হামে লাগে প্রথমে আদিবাসীই/পনতা ভাত ভালোবাসি…’। গান থামতেই কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন, বাপ-দাদারা খেয়েছে তাই খাই। বাবু, পনতা সারা বছর শরীর ঠাণ্ডা রাখে।
বৈশাখের মতো চৈত্রের শেষ দিনেও মুণ্ডারা বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে একে অন্যের গায়ে কাদা আর রং ছিটায়। তাদের বিশ্বাস এতে সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হয়। চৈত্রের শেষ দিন এবং বৈশাখের প্রথম দিনের এই উৎসব তাদের ভাষায় ‘সিরুয়া বিসুয়া’।
এ ছাড়া চৈত্র মাসেই মুণ্ডা পাহানরা আয়োজন করে চৈতালিপূজার। এই পূজায় আগের রাতে উপোস থেকে পরের দিন দুপুরে প্রসাদ দিয়ে উপোস ভাঙাই নিয়ম। মঈনকাঁটা বা বেলগাছের নিচে মাটির উঁচু ডিবি তৈরি করে, লাল নিশান আর ধূপ কাঠি টাঙিয়ে, পান, সুপারি, দুধ, কলা, দূর্বাঘাস, বাতাসা, কদমফুল, সিঁদুর, হাড়িয়া দিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে পূজা দেওয়া হয় চৈতালিপূজায়। একই সঙ্গে তারা বলি দেয় মানতের কবুতর, হাঁস কিংবা পাঁঠা। পূজা শেষে চলে খিচুড়ি আর হাড়িয়া খাওয়া। রাতভর হয় আনন্দ নৃত্য।
তখন সন্ধ্যা হয়। চলে আসি তুরিদের পাড়ায়। কথা হয় গোত্রের প্রধান লবানু শিংয়ের সঙ্গে। এই আদিবাসীদের আচার খানিকটা ভিন্ন। চৈত্র মাসের শেষ পাঁচ দিন তুরিরা পালন করে চৈতাবালির অনুষ্ঠান। শুরুর দিন থেকেই তারা ছাতুগুড় খেয়ে নাচ-গান করে। চৈত্রের শেষ দিন তারা বাড়িতে রান্না করে সাত পদের তরকারি। সাত পদ দিয়ে ভোজ সেরে তারা চৈত্রকে বিদায় জানায়। চলে নাচ-গান পর্বও।
পরের দিনই বৈশাখ। বৈশাখ শুরু হলেই তুরিরা বন্ধ করে দেয় মাছ-মাংস খাওয়া। পুরো এক মাস তারা খায় শুধুই নিরামিষ। প্রতি রাতে পাড়ায় পাড়ায় চলে কীর্তন। কীর্তন করেন শুধুই পুরুষরা। এ সময় দূর-দূরান্ত থেকে অন্যান্য আদিবাসীরাও ভিড় জমায় তুরি পাড়ায়। বৈশাখের শেষের দিকে তারা প্রতি বাড়ি থেকে চাল তুলে একত্রে খিচুড়ি রান্না করে খায়। সৃষ্টিকর্তার কৃপালাভের আশায় চলে এমন আচার। এ সময় তারা বাড়ি-ঘরে আলপনাও এঁকে রাখে।
রাত বাড়তেই ফিরতি পথ ধরি। কানে তখনো ভেসে আসছে আদিবাসী গান আর ঢোলের ছন্দ। আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে বিভিন্ন জাতির এমন লোকজ উৎসব। উৎসবে দলগত নৃত্য, গান, বিশ্বাসের নানা আচার আর প্রাণখোলা আড্ডায় তারা ভুলে যায় তাদের চিরচেনা দুঃখ আর হিংসা-বিদ্বেষের বিভেদটুকু।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে কালের কণ্ঠের শেষের পাতায়, প্রকাশকাল: ২৩ এপ্রিল ২০২৫
© 2025, https:.