পাহাড়ে বর্ষবরণ

চৈত্র-বৈশাখে বাঙালির মতো বিভিন্ন জাতির মানুষেরও সম্মিলন ঘটে নানা উৎসব ও আনুষ্ঠানিকতায়। এসব উৎসবই তাদের মিলনমেলা। উৎসবে দলগত নৃত্য, গান, বিশ্বাসের নানা আচার আর প্রাণখোলা আড্ডায় তারা ভুলে যায় হিংসা-বিদ্বেষের বিভেদটুকু। ফলে তাদের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ আরও সুদৃঢ় হয়।
নতুন বছর আগমনের সময়টায় পাহাড়ে নানা জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা গান ধরে—‘তুরু তুরু তুরু রু- বাজি বাজাত্তে/পাড়ায় পাড়ায় বেরেবং বেক্কুন মিলিনে/এচ্যে বিজু, বিজু, বিজু…’ (তুরু তুরু শব্দে বাঁশি বাজে, গ্রামে ঘুরে বেড়াব সবাই মিলে, আজ বিজু, আজ বিজু)। এ সময়ে চাকমারা বিজু, ত্রিপুরারা বৈসুক, মারমারা সাংগ্রাইং, তঞ্চঙ্গ্যারা বিষু, অহমিয়ারা বিহু উৎসব পালন করে থাকে। এ ছাড়া অন্যান্য জাতি নিজ নিজ নামে অভিহিত করে এ সময়ে তাদের উৎসবটি। কিন্তু কোনো উৎসবের নাম ‘বৈসাবি’ নয়।
মূলত ত্রিপুরাদের ‘বৈসুক’ উৎসব থেকে ‘বৈ’, মারমাদের ‘সাংগ্রাইং’ থেকে ‘সা’ আর চাকমাদের ‘বিজু’ উৎসব থেকে ‘বি’—এভাবে তিনটি নামের আদ্যক্ষর এক করে হয়েছে ‘বৈ-সা-বি’। এমন সম্মিলিত উদ্যোগ শুরু হয়েছে ১৯৮৫ সাল থেকে। এটি আলাদা কোনো উৎসব নাম না হলেও ‘বৈসাবি’ শব্দটিকেই উৎসব হিসেবে গণমাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে। ফলে আলাদাভাবে ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমাসহ অন্যান্য জাতির উৎসবের নামটি প্রায় চাপা পড়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি এ তিনটি ছাড়া অন্যান্য জাতির উৎসব নামটিও থাকছে আলোচনার বাইরে, যা প্রত্যাশিত নয়। তাই গণমাধ্যমকর্মীদের এ বিষয়ে আরও সচেতন থাকার কথা বলছেন গবেষকরা।
বৈশাখে পাহাড়ের উৎসবগুলো সম্পর্কে নিজের গবেষণা থেকে তুলে ধরছি খানিকটা তথ্য।
ত্রিপুরাদের ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও প্রধানতম উৎসব বৈসু বা বৈসুক। চৈত্র মাসের শেষের দুদিন ও নববর্ষের প্রথম দিনটিতে পালন করা হয় এ উৎসব। চৈত্রের শেষ দুদিনের প্রথম দিন অর্থাৎ ২৯ চৈত্র ‘হারিবৈসু’ আর ৩০ চৈত্র বা শেষ দিনটিকে তারা বলে ‘বিসুমা বা বুইসুকমা’। আর পহেলা বৈশাখের দিনটিকে বলা হয় ‘বিসিকাতাল’।
বৈসু উৎসবের তিনটি তাৎপর্য রয়েছে বলে মনে করে ত্রিপুরারা। প্রথমত, তাললাং মাসের ৩০ তারিখে রাষ্ট্রীয়ভাবে ত্রিপুরাব্দ বর্ষপঞ্জিকা প্রবর্তিত হয়েছিল। এ কারণেই এটি বর্ষবরণের দিন। দ্বিতীয়ত, ত্রিপুরাদের বিশ্বাস, তন্ত্রসারে বিষুসংক্রান্তি লগ্নে দিনরাত্রি সমান হয় এবং এদিন অধিক পুণ্যময়। তৃতীয়ত, বৈসু উৎসব দিনগুলোতে গরিয়া নৃত্যোৎসব করে এ জনগোষ্ঠী উদ্দীপনা ও শক্তি সঞ্চয় করে থাকে।
তিন দিনের উৎসবে ‘হারিবৈসুর’ দিনটি হলো ত্রিপুরাদের জন্য ব্যস্ততম দিন। এদিনে বিশেষ শ্রদ্ধায় গবাদি-পশুপাখির পরিচর্যা করা হয়। চন্দন পানি দিয়ে গবাদি পশুদের স্নান করানোসহ তাদের দেওয়া হয় উন্নতমানের খাদ্য ও পানীয়। অতঃপর ফুলের মালা পরিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা ও ক্ষমা প্রার্থনা করে ত্রিপুরা।
ঝুঁড়িতে ধান নিয়ে মোরগ-মুরগিকেও ছিটিয়ে দেয়। এদিন বাড়িঘর নিম ও আমপাতা, দূর্বাঘাস ও ফুল দিয়ে সাজানো থাকে। কেননা ত্রিপুরা সমাজে নিম, আম, ডুমুর, বট ও অশ্বত্থগাছের পাতাকে শান্তির প্রতীক, দূর্বাকে অমরত্বের প্রতীক, ফুলকে ভক্তির প্রতীক আর পান-সুপারিকে কল্যাণের প্রতীক হিসেবে মনে করা হয়।
উৎসবের এদিনে সৃষ্টিকর্তার কাছে মঙ্গল কামনায় ভোরে নদীর তীরে কাদামাটি ও বালুর দেবী তৈরি করে তারা। এটি ‘খুমকামুং’ পূজা। সন্ধ্যায় মৃত আত্মীয়স্বজনদের আত্মার শান্তি কামনা করে মাঙ্গলিক প্রদীপ জ্বালিয়ে নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। একে বলে ‘সিমতং’ পূজা। এ সময় যুবক-যুবতীরা সুন্দর পোশাক পরিধান করে ঢোলের বাজনায় মনের নানা ইচ্ছা নিয়ে কলা বা কাঁঠাল পাতার ঠোঙায় তেলের প্রদীপ জ্বালিয়ে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়। তখন আবেগাপ্লুত হয় তাদের মন। হাজার হাজার প্রদীপ নদীর জলে ভাসতে থাকে। রাতের অন্ধকারে তা অপরূপ দেখায়। এদিন গৃহিণীরা বিশেষ ধরনের প্রাণীয় তৈরি করে থাকে।
চৈত্রের শেষ দিনে বিসুমা পর্বকে ত্রিপুরারা সংযম ও ত্যাগের পর্ব বলে। এদিনে কেউ কায়িক পরিশ্রম, মিথ্যা কথা বলেন না। সকল প্রকার খারাপ কাজ থেকেও বিরত থাকে। এ সময় মাটি কাটা, গাছ ও বাঁশ কাটা এবং প্রাণীবধ নিষেধ থাকে। বিশেষ ধরনের নিরামিষ বা ‘পাচন’ তরকারি খেয়ে ত্রিপুরারা মঙ্গলের জন্য উপাসনা করে।
বিসিকাতাল পর্বে মূলত নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। এ সময় দৈহিক, মানসিক ও জাতির সামগ্রিক মঙ্গলের জন্য পূজা করে ত্রিপুরারা। এদিনে প্রতিটি পরিবার আমিষ খাদ্যের আয়োজন করে। তাদের বিশ্বাস, এদিন কেউ খালি মুখে ফিরে গেলে সারা বছরের জন্য গৃহস্থের অমঙ্গল হয়।
ত্রিপুরাদের বৈসুক উৎসবে ঘরে ঘরে বিচিত্র ধরনের পিঠা আর মদ ও অন্যান্য পানীয় পান করানো হয়। উৎসব শুরু হলে ‘গরাইয়া’ নৃত্যর দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে নৃত্য পরিবশেন করে। এ আনন্দদায়ক লোকনৃত্যে ১৬ থেকে ৫০০ পর্যন্ত লোক অংশ নিতে পারে। ২২টি অসাধারণ মুদ্রা সৃষ্টি করা হয় এ নৃত্যে।
নৃত্যদলের একজনের কাঁধে বাঁধা শূলে থাকে একটি খাদি। ঘরের উঠোনে এ শূলটি বসানো হলে, ওই ঘরের মালিককে গরাইয়া দেবতার পূজা দিতে হয়। নৃত্য শেষে প্রতি বাড়িতেই শিল্পীরা সুর করে ওই গৃহস্থকে আশীর্বাদ করে। তখন সবাইকে মদ, মুরগির বাচ্চা ও চাল তুলে দেওয়া হয়। এভাবে প্রত্যেক বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা সামগ্রী দিয়ে গরাইয়া দেবতার পূজা করে ত্রিপুরারা।
পার্বত্য চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতি মারমা। মারমা বর্ষপঞ্জি অনুসারে মারমা সাল গণনাকে বলা হয় গঃ জাঃ সাকুরাই। ‘তাইংখুং’ মারমা পঞ্জিকা বছরের প্রথম মাস। এ মাসেই উদযাপিত হয় নববর্ষ বরণ অনুষ্ঠান ‘সাংগ্রাইং’। এটি মারমাদের অন্যতম প্রধান সামাজিক উৎসব।
কেন সাংগ্রাইং উৎসব পালন করা হয়? সংক্রান্তি শব্দ থেকেই এসেছে ‘সাংগ্রাইং’ শব্দটি। এ কারণে অনেকেই মনে করেন চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে সাংগ্রাইং উৎসব পালন করা হয়। তবে মারমারা বিশ্বাস করে, এ পৃথিবীতে সাংগ্রাং নামে এক ধর্মীয় দেবী মানুষের সৌভাগ্য আর কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসেন। স্বর্গ থেকে মর্ত্যে দেবী নেমে আসার অর্থাৎ পৃথিবীতে পা রাখার ক্ষণটি থেকেই শুরু হয় সাংগ্রাইং বা নববর্ষ পালনের উৎসব। পৃথিবীতে যে কদিন দেবী অবস্থান করবেন, সে কদিন ধরেই চলে এ উৎসব। সাধারণত তিন থেকে পাঁচ দিনব্যাপী এ উৎসব পালন করে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মারমারা।
সাংগ্রাইংয়ের প্রথম দিনটিকে এরা বলে ‘পাইং ছোয়াইক’ অর্থ ‘ফুল তোলা’। এদিন মারমা যুবতীরা নানা ধরনের পাহাড়ি সুগন্ধি ফুল সংগ্রহ করে। বুদ্ধপূজার রাতে সেসব ফুল সাজিয়ে দল বেঁধে সবাই বৌদ্ধবিহারে গমন করে।
বুদ্ধমূর্তির বেদিতে ভক্তি সহকারে সেই ফুল রেখে তারা প্রার্থনা নিবেদন করে এবং নানা রঙের মোম ও ধূপকাঠি জ্বালিয়ে রাখে। যারা বিহারে যেতে না পারে তারাও নিজ গৃহে রাখা বুদ্ধমূর্তির সামনে ফুলের অর্ঘ্য, মোম ও ধূপকাঠি জ্বালিয়ে প্রণাম ও প্রার্থনা করে। ওইদিন বিকেলে বুদ্ধমূর্তি নিয়ে সব বয়সী মারমারা সারিবদ্ধভাবে গ্রাম প্রদক্ষিণ করে। ওই রাতে মারমা যুবক-যুবতীরা না ঘুমিয়ে গান-বাজনায় ব্যস্ত থাকে। এ সময় তারা নানা পদের ও হরেক রকমের পিঠা-পায়েস তৈরি করে।
উৎসবের দ্বিতীয় দিনটি দেবীর আগমন দিবস। তাই ভোর থেকে রাত অবধি ঘরে ঘরে চলে প্রবীণ পূজা। তৃতীয় দিনটি দেবীর নির্গমন দিবস। এদিন ভোরে এরা মঙ্গলাচরণ, অষ্টশীল গ্রহণ ও পিণ্ডদান, বিকেলে গোলাপ ও চন্দনমিশ্রিত জলে বুদ্ধ স্নান, সন্ধ্যায় প্রদীপ পূজা এবং রাতের আরতি দানের মধ্য দিয়ে উৎসবের সমাপ্তি ঘটায়।
এ ছাড়া মারমা সমাজে রিলংবোয়ে বা জলকেলি অনুষ্ঠানের প্রচলন রয়েছে। এটি যুবক-যুবতীদের মধ্যে সামাজিক ঐক্য, সম্প্রীতি, প্রেম-ভালোবাসায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। তবে নিয়ম হলো—এ সময় পানি নিয়ে কোনো ঝগড়া বিবাদ করা যায় না। কৌণিক বা আড়াআড়িভাবে পানি নিক্ষেপ নিষেধ থাকে। অনুষ্ঠান চলাকালে কেউ কোনো অশোভন, অশালীন বা অশ্লীল আচরণও করতে পারে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃহৎ জনগোষ্ঠী হচ্ছে চাকমারা। বিজু উৎসবের সঙ্গে তাই দুলে ওঠে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম। চাকমারা বিজু উৎসব পালন করে তিন দিন। বাংলা বর্ষের শেষ দিনটিকে এরা মূল বিজু, তার আগের দিনটিকে ফুল বিজু এবং নববর্ষের প্রথম দিনটিকে ‘গুজ্জেই পজ্জা’ দিন বলে।
ফুল বিজুর দিনে ছেলেমেয়েরা খুব ভোরে উঠেই বিভিন্ন ধরনের ফুল তুলে নিজ নিজ বাড়িতে আনে। অতঃপর সেগুলো দিয়ে বুদ্ধপূজা, গৃহ দেবতার পূজা করে থাকে। এ সময় ঘরবাড়ি ও আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ফুলে ফুলে বাড়িঘর সাজানো হয়। গরু, মহিষ ইত্যাদির গলায়ও পরিয়ে দেওয়া হয় ফুলের মালা।
এদিনে সবাই একত্রিত হয়ে শিকারে বের হয়। কেউ কেউ মাছ ধরতে যায় নদীতে। মেয়েরা নানা তরিতরকারি সংগ্রহের জন্য বেরিয়ে পড়ে। বিকেলে গোয়ালঘরে, স্নান ঘাটে সুতালি বাতি বা মোম জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা করা হয়।
মূল বিজুর দিন চাকমারা খুব ভোরে দলে দলে নদী, পাহাড়ি ছড়া বা জলাশয়ে ফুল ভাসিয়ে দিয়ে পুরোনো বছরের গ্লানি ভুলে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। মেয়েরা স্নান সেরে ফুল বিজুর দিনে সংগ্রহ করা প্রায় ২০ রকমের শাকসবজি দিয়ে রান্না করে ‘পাচন’ নামক এক ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবার। এ সময় আগতদের নানা ধরনের খাদ্য ও প্রিয় পানীয় ‘জগরা’ বা ‘কাঞ্জি’ মদ দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।
তৃতীয় দিন বা নববর্ষের প্রথম দিন চাকমারা দল বেঁধে উপাসনালয়ে গিয়ে নতুন বছরের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে। যুবক-যুবতীরা মহানন্দে আকাশ প্রদীপ জ্বালায় এবং বাজি ফোটায়। মূল বিজুর দিনে নানা প্রকার পানীয় ও খাদ্যদ্রব্য খাওয়া হয়। তাই এর পরদিন বা নববর্ষের প্রথম দিনে চাকমারা বিশ্রাম নেয়। এ কারণেই এ দিনটিকে এরা ‘গুজ্জেই পজ্জা’র দিন অর্থাৎ শুয়ে থাকার দিন বলে।
নববর্ষ ঘিরে পাহাড়ে বিভিন্ন জাতির উৎসবগুলো পালিত হয়ে আসছে আবহমানকাল থেকেই। উৎসব ও পূজা-পার্বণগুলো বেশিরভাগই আবর্তিত হয় তাদের সনাতন ধর্মবিশ্বাস ঘিরে। মূলত সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং মনোবাসনা পূরণের নানা ইচ্ছা নিয়েই পালিত হয় এমন উৎসব, যা তাদের স্বকীয়তাকেই তুলে ধরে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে কালবেলায়, প্রকাশকাল: ১৪ এপ্রিল ২০২৫
© 2025, https:.