মনোবাসনা পূরণ হয় সে মেলায়

দিনাজপুরের বিরল উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রাম। প্রায় তিন শ বছর আগে থেকেই বছরে একবার এই রামচন্দ্রপুরে বসে শঙ্খবাণী মেলা। মেলার এক পাশে ছোট্ট একটি মন্দির। এটিই শঙ্খবাণী মন্দির।
মনোবাসনা পূরণের ইচ্ছা নিয়ে মন্দিরটিতে পূজা দেন পূজারিরা। সবার হাতে পাতায় মোড়ানো ধূপ-সিঁদুর। মানত করে সেটি তারা ছুড়ে দিচ্ছে শঙ্খবাণীর দিকে।
কাঁটাতারের বেড়ার ওই পাশেই ভারতের রাধিকাপুর। এই পাশে দিনাজপুরের বিরল উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রাম।
রাধিকাপুর আর রামচন্দ্রপুর একসময় একই জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রায় তিন শ বছর আগ থেকেই বছরে একবার এই রামচন্দ্রপুরে বসে শঙ্খবাণী মেলা। একসময় এই মেলাই ছিল দুই বাংলার মানুষের মিলনমেলা।
সময়ের গতিতে দেশ ভাগ হয়।কাঁটাতার বসে সীমান্তে। ফলে রাধিকাপুরের লোকেরা এখন আর আসতে পারে না এই মেলায়।
হিন্দু পঞ্জিকা মতে বৈশাখ মাসের প্রথম মঙ্গল অথবা শনিতে বিরলের রামচন্দ্রপুরে বসে শঙ্খবাণীর মেলা। শতবর্ষী এক বটের ছায়ায় বসে মেলাটি। মেলা প্রাঙ্গণে আছে অতি প্রাচীন কালো পাথরের মূর্তি।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ওই দিন সেখানে আয়োজন করে পূজাসহ নানা আচারের। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মেলাপাগল মানুষের পায়ের ছাপ পড়ে রামচন্দ্রপুরের মেঠোপথে। মনোবাসনা পূরণের আশা নিয়ে আশপাশের জেলার লোকেরাও ভিড় জমায় শঙ্খবাণী মেলায়।
গেল বৈশাখে গিয়েছিলাম ওই মেলায়। জীর্ণ-শীর্ণ গ্রাম্য রাস্তায় কাঁঠালপাকা রোদে চলি গরম জিলাপি, পাপড় আর পুণ্যসন্ধানীদের মুখ দেখব বলে। চারপাশে সবুজ ধানক্ষেত। বরেন্দ্র অঞ্চলের ধানক্ষেতের সৌন্দর্য অন্য রকম। ঠিক যেন স্তরে স্তরে সবুজ গালিচা বিছানো। দমকা বাতাসে সবুজ প্রাণে চলে উথাল-পাথাল ঢেউ।
মেলায় যখন পৌঁছি তখন দুপুর ছুঁই ছুঁই। বড় একটি বটগাছের ছায়ায় বসেছে মেলাটি। দীর্ঘদেহী ছড়ানো বটগাছটিই যেন মেলার প্রধান সৌর্ন্দয। বটগাছের তলায় নানা বাহারি জিনিস নিয়ে বসেছেন দোকানিরা। বাঁশ আর কাঠের তৈরি নানা রঙের মন-ভোলানো খেলনা কিনতে বাচ্চারা যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।
পাশেই বেশ কয়েকজন দোকানি বসেছেন শাঁখা আর কাচের চুড়ি নিয়ে। চুড়ির শব্দে ঢেউ লেগেছে তরুণীদের মনে। হাত বাড়িয়ে দেখে নিচ্ছেন পছন্দের চুড়িগুলো। কেউ আবার দোকানির হাতেই পরে নিচ্ছেন পছন্দের শাঁখা বা চুড়ি।
মেলার এক পাশে রঙিন কাপড় টাঙিয়ে লাইন ধরে বসেছে কয়েকটি মিষ্টির দোকান। দোকানগুলোর ভেতরের পাম্প চুলায় শোঁ শোঁ শব্দ। সেখানে গরম তেলে নানা ঢঙের জিলাপি ভাজা হচ্ছে। সাজিয়ে রাখা হয়েছে গুড়ের জিলাপি, ছানার সন্দেশ, চমচমসহ নানা রসের মিষ্টি। দূর থেকে দেখলেই জিভে জল এসে যায়। কেউ কেউ দোকানে বসে ফুঁ দিয়ে দিয়ে পালা করে খাচ্ছেন।
মেলার একপাশে ছোট্ট একটি মন্দির। এটিই শঙ্খবাণী মন্দির। মনোবাসনা পূরণের ইচ্ছা নিয়ে মন্দিরটিতে পূজা দিতে লাইন ধরেছে শত শত লোক। সবার হাতে পাতায় মোড়ানো ধূপ-সিঁদুর। মানত করে সেটি তাঁরা ছুড়ে দিচ্ছেন শঙ্খবাণীর দিকে। কেউ কেউ রুপা বা স্বর্ণের পাদুকা বানিয়ে শঙ্খবাণী মূর্তির শরীরে লাগিয়ে দেন।
ভিড় ঠেলে ভেতরে যাই। কথা বলি পূজারির সঙ্গে। তিনি জানান, শঙ্খবাণী নিয়ে প্রচলিত মিথটি।
এখানেই ছিলেন এক রাজা। তাঁরই আদরের একমাত্র মেয়ের নাম ছিল শঙ্খবাণী। একদিন রাজবাড়ির পাশ দিয়ে এক শাঁখারি শাঁখা ফেরি করছিল। শাঁখার কথা শুনে রাজকন্যা শঙ্খবাণীর মন উদ্বেল হলো। ঘরকন্নায় ব্যস্ত রাজকন্যা আকুল হয়ে ছুটে এলো স্নানঘরে নিজের কাপড় ধোয়া ফেলে রেখে। শখ করে শাঁখা কিনল সে, আর কুমারী অবস্থাতেই হাতে পরল সেই শাঁখা। এ খবর ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। শুনে রাজা ক্ষিপ্ত হলেন, ক্রোধের বশে মারতে গেলেন মেয়েকে। বাবার আচরণে শঙ্খবাণী মনের দুঃখে ঝাঁপ দেয় রাজবাড়ির পাশের দীঘিতে।
রাজার উদ্দেশ্যে সে বলে যায়, ‘আজ তুমি আমাকে অপমান করলে, একদিন তুমি আমাকেই পূজা দেবে’। এর কিছুদিন পরেই নাকি এই স্থানে এক রাতে কালো পাথরের মূর্তি ভেসে ওঠে। সেই থেকে এখানে মা শঙ্খবাণীর পূজা হয়ে আসছে। প্রচলিত বিশ্বাস, যে যে-ই ইচ্ছা নিয়ে এখানে আসেন তাঁর সে ইচ্ছা পূরণ হয়ে যায়।
হঠাৎ মন্দিরস্থলে ঢাক-ঢোল আর বাঁশির করুণ সুর বেজে ওঠে। দেবংশী চন্দ্রকান্ত রায় মন্ত্র পাঠ করতে থাকেন। সঙ্গে চলে ঢাকের শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে খালি গায়ে চার যুবক হাতের মধ্যে কবুতর নিয়ে নানা ভঙ্গিতে নাচতে থাকেন। পূজারি জানালেন, দেবতারা নাকি তাঁদের ওপর ভর করেছেন। নাচ শেষে দেবংশী একে একে ভোগ খাইয়ে তাঁদের মুক্তি দেন বা বিসর্জন দেন।
পূজা শেষে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে মেলার কেনাকাটায়। নাতনির জন্য বাতাসা কিনছেন সেতাবগঞ্জের মালতি রানী। বয়স ষাটের মতো। কথা হয় তাঁর সঙ্গে। কী চাইলেন শঙ্খবাণীর কাছে? উত্তরে শুধুই মুচকি হাসি। মনোবাসনার কথা নাকি বলতে হয় না।
বিকেলের দিকে পুরোদমে জমে ওঠে মেলাটি। তিল পরিমাণ জায়গা নেই মেলাপ্রাঙ্গণে। শঙ্খবাণীর টানে বুক ভরা ভালোবাসা নিয়ে সবাই যেন উজাড় করে দিচ্ছে নিজেকে। নানা বাদ্য বাজছে মেলায়। যে যেভাবে পারছে দল বেঁধে ছুটে আসছে মেলাস্থলে।
চারপাশে অন্ধকার নামতেই ফিরতি পথ ধরি। বৈশাখ এলে আজও মনে পড়ে মেলাটির কথা। এ বছরও হবে রামচন্দ্রপুরের শঙ্খবাণী মেলা। মেলার আগেই হাঁক-ডাক শুরু হবে চারপাশে। একে অন্যকে বলবে, ‘চল কেনে বাহে শঙ্ঘবানী মেলাত’।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালের কণ্ঠের শেষের পাতায়, প্রকাশকাল: ৯ এপ্রিল ২০২৫
© 2025, https:.