মে ১৯৭১: স্বাধীনতার পথে দামাল ছেলেদের লড়াইয়ের প্রস্তুতি

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সবচেয়ে বড় গণহত্যার ঘটনাটি ঘটে মে মাসেই, খুলনার ডুমুরিয়া থানার আটলিয়া ইউনিয়নের চুকনগরে।
মে মাসের প্রথম দিন। ব্রিটিশ এমপি ব্রুস ডগলাস-ম্যান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সফর শেষে শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা নিয়ে দ্য সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দেন। বিরোধীদলীয় এই ব্রিটিশ নেতা পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধ করতে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠিও লেখেন।
অন্যদিকে একইদিনে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় পত্রিকা ‘প্রাভদা’ পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা ও মানবিক বিপর্যয়, ধর্ষণ ও মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। পয়লা মে একটি উপ-সম্পাদকীয়তে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও সামরিক প্রশাসনের নিন্দাজনক পদক্ষেপের সমালোচনা করে বলা হয়, এসব কার্যকলাপ পাকিস্তানের ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই অবস্থান অব্যাহত থাকলে তা কেবল পূর্ব পাকিস্তান নয়, ভারত, এশিয়া, এমনকি বিশ্বের জন্যও বিপজ্জনক হবে।
ওই একইদিনেই ইংল্যান্ডের উরস্টার শহরে পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রথম ম্যাচের বিরুদ্ধে প্রায় ছয়শ প্রবাসী বাঙালি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। বিক্ষোভকারীদের হাতে প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘হত্যাকারী খুনিরা ফিরে যাও’, ‘গণহত্যা অবিলম্বে বন্ধ করো’, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘খুনি ইয়াহিয়ার নিপাত চাই’— সহ নানা ধরনের দাবি।
তবে দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানের পক্ষে থাকার অঙ্গীকারও করে কেউ কেউ। ময়মনসিংহ থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক সদস্য সৈয়দ বদরুজ্জামান এদিন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেন। পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখার লক্ষ্যে সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য ময়মনসিংহবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “বিচ্ছিন্নতাবাদী আওয়ামী লীগ এখন দেশের শত্রু। ভারতের দালালী করে এরা পাকিস্তানকে ভাঙ্গার চেষ্টা করছে। তারা কখনোই সফলকাম হবে না। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ কখনোই তাদের সেই দিবাস্বপ্ন পূরণ হতে দিবে না।” (তথ্যসূত্র: দৈনিক পাকিস্তান, ২ মে ১৯৭১, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, অষ্টম, নবম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড, দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ২ মে ১৯৭১)
২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতারের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পশ্চিম পাকিস্তানের কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তা নিয়ে কোনো স্পষ্ট তথ্য ছিল না। ফলে সমগ্র বাঙালি জাতির প্রশ্ন ছিল, তিনি কেমন আছেন? পাকিস্তানি সামরিক সরকার হয়তো বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে— এমন শঙ্কাও ছিল তখন।
কিন্তু ৫ মে এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তথ্য প্রকাশ করে পাকিস্তান সরকার। সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. আকবর খান করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে বলেন, “শেখ মুজিবুর রহমান জীবিত ও সুস্থ আছেন। সামরিক আইন অনুসারে তার বিচারকাজ শীঘ্রই শুরু হবে।”
‘বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন’— এই খবরটি তৎকালীন বাঙালি জাতির জন্য ছিল সবচেয়ে স্বস্তির। ফলে বাঙালি তার প্রিয় নেতার মুক্তির জন্যও লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে। নয় মাসের যুদ্ধের ভয়াবহতা, মানুষ হত্যা ও বিভীষিকার মধ্যেও তারা শেখ মুজিবকেই মনে ধারণ করে স্বাধীনতার শক্তি ও প্রেরণার উৎস হিসেবে।
এদিকে সারাদেশে পাকিস্তানি সেনারা দখলদারত্ব প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি গ্রামে গ্রামে বাঙালিদের ওপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। তাদের সহযোগিতা করে স্বাধীনতাবিরোধী শান্তিকমিটির লোকেরা। যারা অধিকাংশই ছিল মুসলীম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, ইসলামি ছাত্র সংঘের নেতা-সদস্য ও বিভিন্ন জেলায় বসবাসরত অবাঙালি বিহারীরা। তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতাকামী বাঙালি নর-নারীকে নির্মূল করা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর নির্যাতন বেশি হলেও ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাকামী কোনো ধর্মের মানুষই তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি।
১৬ মে শান্তি কমিটির নাম পরিবর্তন করে ‘শান্তি ও সংহতি কমিটি’ করা হয়। পরদিন দেওয়ান ওয়ারাসাত আলী খান, সুলেমান ওসমানী, আনোয়ারুল হক, সাবির আলী, নইম মালিক ও এ এইচ মালিককে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির নির্বাহী পরিষদে সংযুক্ত করা হয়। পরে ২৫ সদস্যবিশিষ্ট প্রাদেশিক শান্তি কমিটির সাধারণ পরিষদও গঠিত হয়।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সবচেয়ে বড় গণহত্যার ঘটনাটি ঘটে মে মাসেই, খুলনার ডুমুরিয়া থানার আটলিয়া ইউনিয়নের চুকনগরে। সাতক্ষীরা-খুলনার মধ্যবর্তী এলাকার একটি বড় বাজার ছিল এটি। সড়ক ও নদী পথে অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল ভালো। তখনো সেখানে পাকিস্তানি সেনাদের তৎপরতা শুরু হয়নি। ফলে খুলনা, বাগেরহাট, বরিশাল, ফরিদপুর, রামপাল, মোড়েলগঞ্জ, কচুয়া, শরণখোলা, মংলা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, চালনার হাজার হাজার মানুষ, বিশেষ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা, এই পথে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যাচ্ছিলেন।
চুকনগর বাজারে এসে মানুষ রান্না-বান্না বা সদাই করতেন, কেউবা বিশ্রাম নিতেন। এরপর তারা সীমান্তের দিকে যাত্রা করতেন। ১৯ মে পর্যন্ত সেখানে মানুষের ভিড় ছিল উপচে পড়া।
‘হিন্দুদের ঢল নেমেছে চুকনগরে’— এমন খবর সাতক্ষীরায় পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে পৌঁছে যায়। আটলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও শান্তি কমিটির সদস্য গোলাম হোসেন এবং ভদ্রা নদীর খেয়াঘাটের ইজারাদার শামসুদ্দিন খাঁ নামে এক বিহারী গোপনে এ তথ্য পৌঁছে দেন।
এরপর কী ঘটল?
২০ মে সকালে পাকিস্তানি সেনারা হানা দেয় চুকনগরে। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। তারা একটি ট্রাক ও একটি জিপে করে প্রথমে মালতিয়া মোড়ের ঝাউতলায় এসে থামে এবং মালতিয়া গ্রামের চিকন আলী মোড়ল ও সুরেন্দ্রনাথ কুন্ডুকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর পাতখোলা বাজারে ঢুকে নিরীহ মানুষদের লাইনে দাঁড় করিয়ে গণহত্যা শুরু করে।
তাদের একটি দল পাতখোলা বিল থেকে চাঁদনী, ফুটবল মাঠ, চুকনগর স্কুল, মালতিয়া, রায়পাড়া, দাসপাড়া, তাঁতিপাড়া, ভদ্রা ও ঘ্যাংরাইল নদীর তীরে আগত মানুষের ওপর গুলি চালায়। ওইদিন মানুষের আর্তনাদে চুকনগরের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। ভদ্রা নদীর জল রক্তবর্ণ ধারণ করে। লাশের কারণে নদীপথও কোথাও কোথাও বন্ধ হয়ে যায়।
সকালে শুরু হওয়া এই গণহত্যা দুপুরে থামে। চার মাইলব্যাপী এই নৃশংসতায় শহীদদের প্রকৃত সংখ্যা আজও অজানা। তবে প্রত্যক্ষদর্শী ও গবেষকরা মনে করেন, ওইদিন চুকনগরে প্রায় ১২ হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। (তথ্যসূত্র: চুকনগর গণহত্যা-মুনতাসীর মামুন, গণহত্যা’৭১-তপন কুমার দে, ৭১ এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ-ডা.এম এ হাসান)
এছাড়া, ৫ মে নাটোরের লালপুর থানার গোপালপুর চিনিকলের ম্যানেজার আনোয়ারুল আজিমসহ ৪৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পুকুরপাড়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই হত্যাযজ্ঞ ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে। স্বাধীনতার পর ওই পুকুরে অসংখ্য কঙ্কাল পাওয়া যায়। ফলে ‘গোপাল সাগর’ নামের পুকুরটি ‘শহীদ সাগর’ নামে পরিচিত হয়।
মে মাসে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এদেশীয় দোসররা এমন হত্যাযজ্ঞ ঘটায় দেশের বহু স্থানেই। এর মধ্যে বরগুনার পিডব্লিউডি ডাকবাংলো, জেলখানা, বিষখালী নদী ও পাথরঘাটা; চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা; নড়াইলের ইতনা গ্রাম; রাজশাহীর জগীশ্বর গ্রাম; সিরাজগঞ্জের হরিণাগোপাল ও বাগবাটি গ্রাম; সিলেটের বালাগঞ্জের বুরুঙ্গা; নাটোরের রামপুরা খাল; সুনামগঞ্জের সাগরদিঘীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের গণহত্যার ঘটনা উল্লেখযোগ্য। (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ৮ম খণ্ড, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ত্রৈমাসিক স্বপ্ন ‘৭১–এর গণহত্যা’-সম্পাদিত আবু সাঈদ; একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর- সুকুমার বিশ্বাস)
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পগুলো ছিল একেকটি টর্চার সেল। সেখানে বাঙালি নারীদের ওপর অমানবিক নির্যাতনের বর্ণনা শুনতে বীর মুক্তিযোদ্ধা (বীরাঙ্গনা) লাইলী বেগমের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। ১৯৭১ সালে তাকে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে কাইয়ার গুদাম ক্যাম্পে তুলে নেওয়া হয়। ওই সময়ের কথা মনে পড়লে তিনি এখনো আতকে ওঠেন।
লাইলী বেগম অকপটে বলেন আদ্যোপান্ত।

“আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি, পিপিএম হাই স্কুলে। তখন যুদ্ধ চলছে। আর্মিরা ক্যাম্প বসায় কাইয়ার গুদামে। তাদের সহযোগিতায় ছিল শান্তি কমিটির লোকেরা। ওরা চিনিয়ে দিত মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের। বাবা ফেঞ্চুগঞ্জে ফরিদপুর গ্রামের আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। ওইসময় তিনি পালিয়ে বেড়ান। ফলে চাচা কালা মিয়াই দেখভাল করতেন আমাদের।
একদিন সন্ধ্যায় বাবার খোঁজে বাড়িতে আসে পাঁচ-ছয়জন। ফরিদপুর গ্রামের মঈন মিয়া, রশিদ মিয়া, মনাই মিয়া, তোতা মিয়া ছিল। ওরা চাচারে ধইরা নিতে চায়। তারে উঠানে নিলেই সাহস করে সামনে যাই। তখন ওরা আমারেও তুইলা নিয়া যায় কাইয়ার গুদামে।
ওটা ছিল খুবই অন্ধকার জায়গা। মানুষের গোঙানির শব্দ পেতাম। আরও নারীরা ছিল। মাঝেমধ্যে তাদের কান্না আর চিৎকার সহ্য করতে পারতাম না। সেখানে আমার ওপরও চলে শারীরিক নির্যাতন আর অত্যাচার। ওই নির্যাতন কোনো নারীই মুখে বলে বুঝাতে পারবে না।
প্রথম পাঁচ-ছয়দিন একটা রুমে রাখে ওরা। পরে আরেকটা রুমে শিফট করে দেয়। ওখানে রাখে এক মাস। চলে পালাক্রমে নির্যাতনও। খাবার দিত না ওরা। দুই-তিনদিন পর মন চাইলে এক বেলা দিত রুটির সঙ্গে একটু ডাল। একদিন শারীরিক নির্যাতনে অজ্ঞান হয়ে যাই। ওরা তখন আমারে এনে ফেলে দেয় মাইজ গাঁও স্টেশনের পাশে। পরে দুই মাস চিকিৎসা চলে হাসপাতালে।

কাইয়ার গুদামের বড় বড় বাঙ্কার ছিল। সেখানে রাখা হতো শত শত নারীকে। স্বাধীনের পর আড়াই থেকে তিনশর মতো নারীকে বের করা হয়েছিল। পুরুষ আর নারী সবাইকেই ওরা প্রথমে ঢুকাইতো কাইয়ার গুদামে।
আমার মাথায় কাটার দাগ এখনও আছে। বাইশটা শিলি পড়ছিল। দেখেন মুখে ক্ষত। বেয়নেট দিয়ে পাঞ্জাবিরা গুতা দিছে। ডান হাতটা ভাঙ্গা। পায়ের ক্ষতি করছে। রানের ভেতরও বেয়নেটের খোঁচার দাগ আছে অগণিত।
প্রজন্মের কাছে এখন তো টর্চারের কথা বলতে লজ্জা লাগে, ভয়ও লাগে। এখন তো কিছু মরা, কিছু জিন্দা হিসেবে বেঁচে আছি। সরকার মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়েছে, তাতে ভালো আছি। কিন্তু ওই কাইয়ার গুদামের পাশ দিয়ে গেলেই বুকের ভেতরটা ধুপ করে ওঠে।”
গণহত্যা যখন চলছে তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরি ও নানা দাবি উঠতে থাকে।
মে মাসেই জাতিসংঘের উদ্বাস্তুসংক্রান্ত হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “ভারতের রাজ্যগুলোতে অসংখ্য উদ্বাস্তু মানবেতর জীবন যাপন করছে। তাদের সংস্থা শরণার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে তারা স্থায়ী উদ্বাস্তুতে পরিণত হোক, সেটা কারও প্রত্যাশা নয়। পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা দরকার, যাতে আর কোনো শরণার্থী ভারতে না আসে এবং দেশত্যাগীরা স্বদেশে ফিরে যেতে পারে।”
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের চারজন সিনেটরের কাছে পররাষ্ট্র দপ্তরের সচিব ডেভিড অ্যাবশায়ারের লেখা একটি চিঠি ওয়াশিংটনে প্রকাশ করা হয়। ওই সিনেটরেরা পাকিস্তানকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও রাজনৈতিক সাহায্য সম্পর্কে পররাষ্ট্র দপ্তরে চিঠিও লিখেছিলেন। অ্যাবশায়ার সিনেটরদের জানান, চীনা আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের যেসব বিমান ও ট্যাংক পাকিস্তানকে দেওয়া হয়েছিল, পাকিস্তান সরকার ওইসব অস্ত্র পূর্ব পাকিস্তানে ব্যবহার করছে। পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের এম ২৪ ট্যাংক ও এফ ৮৬ বিমান ব্যবহার করা হয়েছে। এসব অস্ত্র ব্যবহারের কারণে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
আবার ২৭ মে মার্কিন সিনেটের উদ্বাস্তু সংক্রান্ত সাব-কমিটির চেয়ারম্যান প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ও ভারতে অবস্থানরত বাঙালি শরণার্থীদের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে আবেদন জানান। তিনি বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানে উদ্বাস্তু সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এই সমস্যা সমাধানে বিশ্বের সকল দেশের এগিয়ে আসা উচিত।” (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ১৩তম খণ্ড)
এমন বিবৃতি ও প্রতিবাদ উত্থাপিত হতে থাকে দেশে দেশে। এদিকে ভারতের সহযোগিতায় বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্পে তখন ট্রেনিং দেওয়াও শুরু হয়ে যায়।
কেমন ছিল ওই ট্রেনিং?
কথা হয় ভারতের বিহার চাকুলিয়া ক্যাম্পে ট্রেনিং নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা শেখ সানোয়ার উদ্দিন রিন্টুর সঙ্গে। জীবদ্দশায় তার মুখোমুখি হই আমরা।
তার ভাষায়, “অনেকে বলেন একাত্তরে আওয়ামী লীগ নেতারা ভারতে গিয়ে বসে ছিলেন। নেতারা ওখানে না গেলে কাদের সাথে যোগাযোগ করতাম, হাতিয়ার কীভাবে আসত, প্রশিক্ষণ কোথা থেকে নিতাম। নেতাদের উদ্যোগেই করিমপুর ইয়ুথ ক্যাম্প চালু হয়। সেখানে আমাদের বাছাই করে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতের বিহার চাকুলিয়া ক্যাম্পে।

ট্রেনিং খুব সহজ ছিল না। আমাদের ছয়টা ছেলের কবর আছে ওখানে। সাপে কেটে মেরে ফেলেছিল ওদের। আমার উইংয়ের দায়িত্বে ছিলেন আহসানুল হক বাবলা, আব্দুর রহমান প্লাটুন কমান্ডার। পুরো চাকুলিয়া ক্যান্টনমেন্টের দায়িত্বে ছিলেন কর্নেল চ্যাটার্জি। ট্রেনার সুখদেব সিং ও মেজর ফাটকার কথা এখনও মনে আছে। আপন ভাইয়ের মতোই আন্তরিক ছিলেন তারা।”
শুধু স্থল যুদ্ধই নয়, একাত্তরের মে মাসেই শুরু হয় অপারেশন জ্যাকপটের নৌ-কমান্ডোদের ট্রেনিং। নৌ-কমান্ডো মো. শাহজাহান কবির বীরপ্রতীকের মুখোমুখি হলে তিনি জানান এর আদ্যোপান্ত।

“আটজন বাঙালি সাবমেরিনার ফ্রান্স থেকে পালিয়ে চলে আসেন দিল্লিতে। প্রবাসী সরকার তাদের কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করে। বাংলাদেশ যেহেতু নদীমাতৃক দেশ। তাই নেভাল ইউনিট প্রয়োজন। এ কারণে নৌ-কমান্ডো বাহিনী গঠন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে উদ্দেশ্যেই ইন্ডিয়ান নেভির তিনজন অফিসারসহ মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আমাদের হাতিমারা ক্যাম্পে আসেন বাঙালি সাবমেরিনারদের একজন, রহমত উল্লাহ (বীরপ্রতীক)।
‘নৌ কমান্ডো হিসেবে কারা যোগ দিতে প্রস্তুত?’ প্রশ্ন করতেই অনেকে হাত তোলে। কিন্তু তারা বেছে নিল যাদের বাড়ি চট্টগ্রাম, মংলা, খুলনা, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জের মতো এলাকায়।
যোগ্যতা কী?
সাঁতার জানতে হবে। বিদেশিরা ট্রেনিং দেবেন। তাই ইংরেজি জানা শিক্ষিত বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া হতে হবে। প্রাথমিকভাবে ৭০-৮০ জনকে বাছাই করা হয়। এরপরই জানানো হলো, ‘এটা হবে সুইসাইডাল স্কোয়াড।’
পরের প্রশ্ন, ‘স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে রাজি কারা?’
অনেকেই তখন হাত নামিয়ে নেয়। অতঃপর ফিটনেস দেখে সিলেকশন করা হয় ৩০-৩২ জনকে। এভাবে বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে সর্বমোট ৩০০ জন সিলেক্ট হয়। অতঃপর ধর্মনগর হয়ে ট্রেনে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় ভারতের মুর্শিদাবাদে।
ট্রেনিং ক্যাম্পটি ছিল পলাশীতে, ভাগিরথী নদীর তীরে। ১৪ মে আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেনিং শুরু হয়। উল্টো বা চিৎ হয়ে সাঁতার কাটা, পায়ে ফিনস পড়ে শুধু চোখ-নাক ভাসিয়ে পানিতে মাছ বা সাপের মতো নিঃশব্দে চলা, অপারেশনে পাহারাদারদের মারতে জুডো-কারাতে ট্রেনিং, দিক চেনার জন্য ম্যাপ রিডিং, মাইন বিস্ফোরণ প্রভৃতি।
একেকটা মাইনের ওজন ছিল ৫ থেকে ৬ কেজি। অপারেশনে সেগুলোই জাহাজে ফিট করে উড়াতে হবে। বুকে দুই-তিনটা ইট বেঁধে সে কৌশলই শেখানো হয় ভাগিরথী নদীর জলে। প্রতিদিন ১৮ ঘন্টা ট্রেনিং হতো, তা চলে ৩১ জুলাই পর্যন্ত। ভারতীয় নৌ-বাহিনীর কমান্ডার এমএন সামন্ত, লে. কমান্ডার জিএম মার্টিস, লে. কপিল, কে সিং ও ক্যাপ্টেন সমীর কুমার দাশের তত্ত্বাবধানে ট্রেনিং হয় নৌ-কমান্ডোদের। ট্রেনিং করান কে এম দাস, ভট্টাচার্য, কফিল, সিসিং, নানাবুজ প্রমুখ।”
এভাবেই পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ে ধীরে ধীরে নিজেদের তৈরি করতে থাকে বাঙালি দামাল ছেলেরা।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ২০ মে ২০২৫
© 2025, https:.