১৯৭১: শেকড়ের ইতিহাসে রাজাকারের স্বরূপ

স্বাধীনতার পরপরই যুদ্ধাপরাধী, রাজাকারসহ পাকিস্তানপন্থি সকল বাহিনীর তালিকা চূড়ান্ত ও বিচার করা যুক্তিযুক্ত ছিল। কিন্তু সেটি করতে না পারার ব্যর্থতায় বাঙালি জাতিকে এখনও চরম মূল্য দিতে হচ্ছে।
একাত্তরে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সহযোগিতা করতে একটি বাহিনী গঠন করা হয়। নাম দেওয়া হয় রাজাকার বাহিনী৷ খুলনার খানজাহান আলী রোডের একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন পাকিস্তানপন্থি ব্যক্তিকে নিয়ে গঠিত হয় এ বাহিনী। পরে অর্ডিন্যান্স জারি করে আনসার বাহিনীকে বিলুপ্ত করে রাজাকার বাহিনীতে রূপান্তর করে পাকিস্তান সরকার।
রাজাকার বাহিনী গঠনের পেছনে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন নেতা এ কে এম ইউসুফ। প্রথম দিকে এ বাহিনী ছিল শান্তি কমিটির অধীনে। বাহিনীতে প্রায় ৫০ হাজার সদস্য ছিল। তাদের প্রতি মাসে দেড়শ রুপির মতো ভাতাও দেয়া হতো। পরে রাজাকার বাহিনীকে আধাসামরিক বাহিনীর স্বীকৃতি দেয় পাকিস্তান সরকার৷ ফলে রাজাকারদের নামে ইস্যু করা হয় অস্ত্র৷ তাদের ভাতা ও পরিচয়পত্র দেওয়া হয় প্রতিটি জেলার এসডিও অফিস থেকে৷
রাজাকারের পাশাপাশি আলবদর নামে আধাসামরিক আরেকটি সশস্ত্র বাহিনীও গড়ে তোলা হয়। ওই বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৭৩ হাজার। ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্য ছাড়াও অবাঙালি ও পাকিস্তানপন্থি অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অনেকেই যোগ দিয়েছিল আলবদর বাহিনীতে। আলবদররা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হয়ে যুদ্ধও করেছে। পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলীর নির্দেশে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নও করেছে এ বাহিনীটি।
একাত্তরে বাঙালি নিধনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আলশামস নামে একটি প্যারামিলিটারি বাহিনীও গঠন করেছিল। ওই বাহিনীর সদস্য ছিল প্রায় তিন হাজারের মতো। ইসলামী ছাত্র সংঘের বাছাইকৃত কর্মীদের নিয়ে সংগঠিত আলশামস বাহিনীর সঙ্গে তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীরও সংযোগ ছিল। তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে গণহত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটনে সহযোগিতার পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে নিজেরাও হত্যাযজ্ঞে অংশ নেয়। (তথ্যসূত্র: শান্তিকমিটি ১৯৭১, আলবদর ১৯৭১, জনতার ৭১-এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ: ডা. এম এ হাসান প্রভৃতি)
পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখাসহ মুক্তিকামী বাঙালি নিধনে উল্লেখিত বাহিনীগুলোর আলাদা আলাদা নাম থাকলেও সাধারণ মানুষের কাছে তারা রাজাকার বাহিনী হিসেবেই পরিচিতি পায়৷ আবার এ বাহিনীগুলো ছাড়াও একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে কাজ করেছে এমন ব্যক্তিকেও সাধারণ অর্থে রাজাকার বলা হয়ে থাকে৷

তৃণমূলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে আনার কাজ করছি এক যুগের অধিক সময় ধরে। ফলে প্রায় দুই শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার মুখোমুখি হওয়ার সৌভাগ্যও হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিতে তৃণমূলে স্বাধীনতাবিরোধীদের অত্যাচার ও হত্যাষজ্ঞের ঘটনাগুলো কিন্তু এখনও হারিয়ে যায়নি। বরং তা সূর্যের মতোই জীবন্ত হয়ে আছে। ওই সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের কার্যক্রম কেমন প্রত্যক্ষ করেছেন? তাদের চোখে রাজাকারদের রূপটি কেমন? তা তুলে ধরতেই এই লেখার অবতারণা।
জুটমিলের লেবার সর্দার বাচ্চু রাজাকার
চাঁদপুরের মুক্তিযোদ্ধা নৌ-কমান্ডো মো. শাহজাহান কবির (বীরপ্রতীক)। একাত্তরে রাজাকারদের কারণেই জীবন দিতে হয়েছে তার পিতা ইব্রাহীমকে বিএবিটি। চাঁদপুরের সবার কাছে তিনি ‘বিটি’ সাহেব নামে পরিচিত ছিলেন। স্কুল শিক্ষক ছিলেন তিনি। একাত্তরে স্কুল খোলা রাখার পাকিস্তান সরকারের নির্দেশ অমান্য করে তিনি ফরমালি স্কুল বন্ধ রেখেছিলেন। চাঁদপুর মহকুমার সংগ্রাম কমিটিরও সদস্য ছিলেন। একাত্তরে তার কাজ ছিল ছাত্র ও যুবকদের ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতে পাঠানো। জুন ও জুলাইয়ের দিকে ট্রেনিং করতে গেলে স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির চিঠি লাগত। ওই সময় তিনি যুবক ও ছাত্রদের চিঠি লিখে এবং প্রয়োজনে টাকা পয়সা সংগ্রহ করে ট্রেনিংয়ে পাঠাতেন। এটাই ছিল তার মুক্তিযুদ্ধ।
বাবার শহীদ হওয়ার ঘটনাটি শাহজাহান বললেন যেভাবে, “যেহেতু জ্যাকপট অপারেশনের আগে পুরো গ্রুপ নিয়ে প্রথম উঠেছিলাম বাড়িতে। এ খবর রাজাকারদের মাধ্যমে পেয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। ওরা জানত আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। তাই ওরা নৌ-কমান্ডোদের খুঁজতে বাড়ি অ্যাটাক করে।
১৭ অগাস্ট ১৯৭১, সকালবেলা। গোপনে চার-পাঁচটা নৌকায় বাড়ির চারপাশ ঘেরাও দেয়। অতঃপর ব্রাশ ফায়ার করতে থাকে। সেনাদের সঙ্গে ছিল রাজাকাররা। ওরা আমার সঙ্গে বাবাকেও বেঁধে পিটাতে থাকে। বুটের লাথিতে যন্ত্রণায় তিনি বাঁকা হয়ে যান। তা দেখে ছটফট করি।
বাবাকে ওরা জিজ্ঞেস করে, ‘নৌ–কমান্ডোরা কোথায়?’
মার খেয়েও তিনি মুখ খোলেন না। বলেন, ‘এখানে কেউ আসে নাই।’ বাড়ি সার্চ করে ওরা কোনও অস্ত্র পায় না। ফলে আমাদের বেঁধে নৌকায় তুলে পিটাতে থাকে।
৪-৫শ গজ দূরে ছিল কামেলি সাহেবের লজ। ওই বাড়িটি লুট করতে নামে ওরা। আমার হাত ও পা বাঁধা। নৌকায় বাবাকে পাশেই ফেলে রেখেছে। ব্যথায় উনি গোঙ্গাচ্ছেন। জুটমিলের লেবার সর্দার ছিল বাচ্চু রাজাকার। সেও নৌকায়। বুড়ো মানুষ দেখে আরেক রাজাকারের দয়া হয়। সে বাবার হাত ও পায়ের বাঁধন খুলে দেয়। পাকিস্তানিদের বুটের আঘাতে তার সারা শরীর ফুলে গিয়েছিল। আমি তখন আল্লাহকে ডাকছি আর সুযোগ খুঁজছি।
কামেলি লজে কেউ নেই। বাড়ির পাশের পাটখেতে লুকিয়ে ছিল তার মেয়ে ঝরনা। সঙ্গে সোনা ও টাকার আট নয়টা ট্রাংক। কীভাবে যেন ওরা টের পেয়ে যায়। পাটখেত থেকে ধরে এনে তারা তাকে নৌকায় তোলে। তখন পাকসেনাদের কুদৃষ্টি পড়ে মেয়েটির দিকে। রাজাকাররাও ব্যস্ত থাকে ট্রাংকের টাকা ও সোনা-রূপা আনলোড করায়।
এ সুযোগে বাবা আমার কানে কানে বলেন, ‘তুই এখান থেকে পালা।’ বলি, ‘আপনার অবস্থা কী হবে?’ বলেন, ‘আমার চিন্তা করিস না। তোকে ধরে নিয়ে গেলে যদি জানে তুই নৌ-কমান্ডো তাহলে মেরে ফেলবে। পুরো গ্রুপটাই ধরা পড়ে যাবে। তোদেরকে দেশটা স্বাধীন করতে হবে। তুই পালা।’
এটা বলেই কৌশলে আমার হাত ও পায়ের বাঁধনও খুলে দেন। বাবার সাথে ওইটা শেষ স্মৃতি।

অস্ত্র হাতে নৌকার দুই পাশে দুজন দাঁড়ানো। এক সাইডে একটারে পা ধরে পানিতে ফেলে দিই। এরপরই আমি ঝাঁপ দিই। আমার দিকে ওরা ব্রাশ ফায়ার করে। কিন্তু তার আগেই ডুব দিয়ে অনেক দূরে চলে যাই।
বাবার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছিল। কী করব ভাবছি। ওরা বাবাকে ভীষণ টর্চার করে। এরপর কানে আসে কয়েকটি গুলির শব্দ। বুকের ভেতরটা তখন খামচে ধরে। তাকে গুলি করে ওরা ওই বাড়ির পাশে অর্ধেক পানিতে ও অর্ধেক রাস্তায় ফেলে যায়। গ্রামবাসী পরে লাশ উদ্ধার করে। ১৮ অগাস্ট বিকেলে বাবাকে দাফন করা হয় পারিবারিক গোরস্তানে।
আমার জন্যই বাবা শহীদ হয়েছেন। বেদনায় চোখ ভিজে যায়। চিৎকার করে কাঁদতেও পারি না। ছেলেকে বাঁচানোর অপরাধে শহীদ হয়েছেন আমার বাবা। পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারেরা তাকে গুলি করে মারে। বাবার দেওয়া জীবন নিয়েই বেঁচে আছি ভাই।’’
‘রেজাকাররা না থাকলে পাকিস্তানিরা এত গণহত্যা চালাইতে পারত না’
আরেক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. জমির আলী। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন পাঁচ নম্বর সেক্টরে। তার ভাষায়, “যুদ্ধ চলছে তহন। চৈত্র মাস। আর্মি আসে সুনামগঞ্জ, টেংরাটিলা আর ছাতকে। ওরা আইসাই অত্যাচার শুরু করে। ওগো সাহায্য করে শান্তি কমিটির লোকেরা। অনেক মাওলানা কাজ করে শান্তি কমিটিতে। ওরা চাইত পাকিস্তান থাকুক। আমাগো ওইখানে শান্তি কমিটির নেতা ছিল আসকর আলী মাস্টার, মাওলানা আবদুস সাত্তার ও রউস মৌলভী। পাঞ্জাবি আইলেই ওরা খেদমত করত। পরে তো রেজাকারে (রাজাকার) লোকজন ভর্তি হইতে থাকে। ওরা অত্যাচার করছে বেশি। আর্মি আসত মাঝে মাঝে। রেজাকাররা ওগো বাড়ি চিনাইত। যুবতী মেয়ে আর খাসি সাপ্লাই দিত। হিন্দু বাড়িতে আক্রমণ করছে বেশি, লুটতরাজও করছে অনেক।
ওইখানে নামকরা রেজাকার ছিল বুধাই। তবে ফকির চেয়ারম্যান ছিল তার চেয়েও ভয়ঙ্কর। সুরমা নদীর উত্তরের ঘটনা। একবার ট্রেনিংয়ের লাইগা ১৩ জন ছাত্র বর্ডার পার হইতেছে। এ খবর ফকির চেয়ারম্যান পাঞ্জাবিগো দিয়া আসে। ওরা আইসা সবাইরে গুলি কইরা মারছে।
আমার বয়স তহন তেইশ-চব্বিশ। রেজাকারগো অত্যাচার সহ্য হইতেছে না। কী করমু? কই যামু?
হঠাৎ একদিন আমার বড় বাপ বাড়িত আইল। উনার নাম ওয়ারেশ আলী পীর সাহেব। উনি উৎসাহ দিয়া কইলেন, ‘যা দেশ স্বাধীন কর গিয়া…বইয়া থাকিস না…অবশ্যই দেশ একদিন স্বাধীন হইব।’ পরে তিনিই মুক্তিবাহিনীতে যাওয়ার রাস্তা দেহাইয়া দেয়।”
জমির আলীরা ছিলেন গেরিলা। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি এক দালালকে ধরে আনার ঘটনাও তিনি তুলে ধরেন যেভাবে, “নির্দেশ পাইয়া আমরা বাঁশতলা থিকা গ্রুপ নিয়া রাতে চর বারকুয়া গ্রামে যাই। ওইটা ছিল ছাতকে। গ্রামের চেয়ারম্যান মওলানা আব্দুল হক ছিল পাকিস্তানিগো বড় দালাল। মৌলভী কইলেই সবাই চিনে। ওর বাড়ির চাইর পাশে রাজাকাররা পাহারা দিত। রাতে ওগো ফায়ার করতেই সবাই পালাইয়া যায়। মৌলভীরে ধরতেই ফজরের আজান পইড়া যায়। তহন তাড়াতাড়ি ওই গ্রাম ছাইরা শ্রীপুর গ্রামে আসি।
ছোট্ট গ্রাম। চারপাশে হাওর। ওই গ্রামের আশোক আলী ছিল মুক্তিযোদ্ধাগো পক্ষের লোক। তার বাড়িত আমাগো আশ্রয় দেন। খাসি জবাই করে খাওয়ারও ব্যবস্থা করেন। গোটা দিনটাই ওইখানে রইছি।
খুব কাছেই ছিল পাকিস্তানিগো একটা ক্যাম্প। শ্রীপুর গ্রামে এক ইমাম ছিল। সে গিয়া ক্যাম্পে পাক আর্মিগো খবর দিয়া আসে। কিন্তু ওরা আসার আগেই আমরা বর্ডারে চইলা যাই। আমগো না পাইয়া পাঞ্জাবিরা ওইদিন গোটা গ্রামটাই জ্বালায়া দিছিল। রেজাকাররা না থাকলে একাত্তরে পাকিস্তানিরা এত গণহত্যা চালাইতে পারত না।”
যুবক পেলেই বাধ্য করা হতো রাজাকারে যেতে
কালিয়াকৈর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা মো. হাবিবুর রহমান। একটি ঘটনা তুলে ধরে তিনি একাত্তর নিয়ে আলাপচারিতা শুরু করেন এভাবে, “ট্রেনিংয়ে যখন যাই তখন অনেকেই সঙ্গে যেতে চেয়েছিল। তাদের বয়স ছিল কম। ফলে রেখে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। নবম শ্রেণিতে পড়ত আব্দুস সালাম ও বাবুল। ওদের বাড়ি পিপড়াছিটে। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে তাদের। যাওয়ার সময় বুঝিয়ে বলেছিলাম, ‘ফিরে এসেই তোদের ট্রেনিং দিমু’। গ্রামে থেকেও ওরা গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কাজ করেছে।
শান্তি কমিটির লোকেরা ওইসময় গ্রামে গ্রামে হানা দিত। পরে পাকিস্তানের অনুসারী অনেকেই মিলে কালিয়াকৈরে রাজাকার বাহিনীও গড়ে তোলে। অতঃপর তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে যুবক ও তরুণদের রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে বলে। রাজাকারে যারা যায়নি তাদের ওরা তুলে দিত পাকিস্তানি আর্মির হাতে। মেরেও ফেলছে অনেককে। ধনী বা গরীব দেখে নাই। যুবক পেলেই রাজাকারে যেতে বাধ্য করা হতো। কেউ কেউ গিয়েছে নিজ থেকেই। গরীব পরিবারের অনেকেই যায় বেতন আর রেশনের লোভে।
রাজাকার বাহিনীতে না যাওয়ায় সালাম ও বাবুলের ওপরও চড়াও হয় শান্তি কমিটির লোকেরা। চলাচলের জন্য তখন আর্মি ক্যাম্প থেকে কার্ড দেওয়া হতো। ওই কার্ড করতে একদিন তারা যায় কালিয়াকৈরে। ওখানে তাদের পেয়ে রাজাকারেরা তুলে নেয়। পরে নির্মমভাবে হত্যা করে। সালাম ও বাবুলের কথা মনে হলে এখনও বুকের ভেতরটা খামচে ধরে। আমাদের সঙ্গে নিয়ে গেলে হয়তো তারা লাশ হতো না। এমন অপরাধবোধ আজও জাগে মনে। একাত্তরে এমন শত শত ঘটনা ঘটেছে। ওইসব ইতিহাস এখনও উঠে আসেনি ভাই।”
ওরা নিজের ছেলেমেয়েদের রাজাকার বানায় নাই!
মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মো. আবুল হোসেন। সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেওয়াসহ দুই নম্বর সেক্টরের নির্ভয়পুর সাব-সেক্টরে এফএফদের (ফ্রিডম ফাইটার) পরিচালনায় বিশেষ দায়িত্ব পালন করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকদের কার্যক্রম নিয়ে এই বীর বলেন, “একাত্তরের জুনের শেষ দিকে আমাদের গ্রুপগুলোর চলাফেরা করা কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ তখন অস্ত্র হাতে পথে পথে থাকত রাজাকারের লোকেরা। ওরা পাকিস্তানি সেনাদের রসদ সরবরাহ করত। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যারা কাজ করত তাদের ইনফরমেশনগুলো তারাই পাকিস্তানি সেনাদের দিয়ে আসত। শান্তি কমিটির নেতারা নিজের ছেলেমেয়েদের কিন্তু রাজাকার বানায় নাই! তারা তাদের এলাকার গরীব ছেলেদের বেশি রিক্রুট করত। ট্রেনিং দিয়ে লোভ দেখিয়ে তাদের বলত, ‘লুটের মাল জায়েজ। সেটা তোমরা পাবা।’ ওরা ব্রিজ পাহারা দিত। ফলে গেরিলাদের সাথে রাজাকারদের যুদ্ধ হয়েছে বেশি। যদি শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর আর আলশামস না থাকত তবে একাত্তরে পাকিস্তানি সেনারা এত মানুষকে হত্যা করতে পারত না!”
রাজাকারগো নির্যাতনের বদলা নিতেই যুদ্ধে যাই
মুক্তিযোদ্ধা সেকেন্দার আলীর গ্রামের বাড়ি খুলনার নালিয়ার চরে। ট্রেনিংয়ে যাওয়ার আগেই তিনি রাজাকারদের নির্যাতনের শিকার হন। ওই অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন এভাবে, “যুদ্ধে যামু। ভেতরে ভেতরে খুঁজতেছি কারা যায়। এক গ্রুপের খবর পাই। কিন্তু ওরা আমারে নেয় না। কিছু খরচ তো সাথে নিতে হইব। মারে বলছি, ‘টাকা দাও। যুদ্ধে যামু।’ মা মানা করছে। বলে, ‘যাওয়ার দরকার নাই বাপ। একসঙ্গে থাকব। পাঞ্জাবিরা যদি আইসা মারে সবাই একসাথেই মরমু।’
আমার খুব রাগ হইল। বললাম, ‘ওগো গুলি খাইয়া আমি মরমু না। তুমি টাকা দিলেও মুক্তিযুদ্ধে যামু, না দিলেও যামু।’ তহনই ঘটল আরেক ঘটনা।
অগাস্ট মাস তহন। বড় ভাই থাকত কালিয়া উপজেলা থেকে একটু দূরে, চাচরি কদমতলায়। একদিন ওখানে যাচ্ছিলাম। কালিয়াতে যে রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকেরা ক্যাম্প বসাইছে জানতাম না। ওরা আমারে আটকায়।
কয়: ‘তুই মুক্তিবাহিনীর লোক। তুই জানস মুক্তিবাহিনী কোথায়? সত্য কথা বললে ছাড়ি দিমু। মিথ্যা কইলে গুলি করমু।’
আমি কই: ‘সারা দিন কাজ করি মাঠে। আর সন্ধ্যা হলেই বাড়িত ঘুমাই। মুক্তিবাহিনী কখন আসে কখন যায় আমি তো দেহি নাই।’
আমারে খুব মারে ওরা। মেজরের কাছে নিয়া যায়। এমপির অফিসে ছিল ওগো ক্যাম্প। সন্ধ্যায় আমারে একটা বাঙ্কারের সামনে নিয়া বসায়। আমাকে শুনায়া ওরা প্রচণ্ড গালাগালি করে বঙ্গবন্ধুরে। সে গালির কোনো শেষ নাই। ওরা খেয়াল করে আমি উত্তেজিত হই কি না। উত্তেজিত হইলেই বুঝব মুক্তিযোদ্ধা।
সকালের দিকে কয়েকটা চর মাইরা ছাইড়া দিল। আমার তহন জেদ চাইপা গেল। খালি খালি ওরা আমারে মারল। ওগো তো ছাড়া যাইব না। বাড়িত আইসাই যোগাযোগ হয় গ্রামের বুলু মোল্লার লগে। তার নেতৃত্বেই এক সকালে ১৯ জনের লগে ট্রেনিংয়ে যাই। রাজাকারগো নির্যাতনের বদলা নিতেই যুদ্ধে যাই।”
ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে এটিই ছিল ওদের কাছে অপরাধ
কথা হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জে শহিদ মহিউদ্দিনের (গাজী মহিউদ্দিন) ছোট ভাই আবুল কাশেমের সঙ্গে। পাকিস্তানি আর্মি রাজশাহী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ দখলে নিয়ে ইপিআর ক্যাম্পে ঘাঁটি গাড়ে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরা রেলওয়ে জংশনে ছিল বিপুল সংখ্যাক বিহারীর আবাস। পাকিস্তানি আর্মি তাদের সহযোগিতার জন্য ওখানেও একটি ক্যাম্প করে। ফলে চাঁপানবাবগঞ্জের ইপিআর ক্যাম্পের সঙ্গে আমনুরা ক্যাম্পের সংযোগ সড়কটি দিয়ে আর্মি নিয়মিত যাতায়াত করতে থাকে। ওই সড়কের পাশেই ছিল কাশেমদের বাড়ি।
তার চাচা মাহতাব উদ্দিন তখন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চলে গেছেন ভারতে। এ খবর চলে যায় শান্তি কমিটির লোকদের কাছে। ফলে গ্রামের শান্তি কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাদ্রাসা শিক্ষক এমরান আলীর নেতৃত্বে একদিন তাদের বাড়ি পোড়ানো হয়।
তার ভাষায়, “পাশাপাশি দুটো বাড়ি। একটিতে দাদা ও মাহতাব চাচা, আরেকটাতে আমরা থাকতাম। বাড়ি পুড়িয়ে দিলে কোথায় থাকব? শান্তি কমিটির সাধারণ সম্পাদক এক সময় আমাদের মসজিদের পেশ ইমাম ছিলেন। বাবা তার সঙ্গে দেন-দরবার করেন। পরে সিদ্ধান্ত হয়, শুধু মাহতাব চাচার ঘরটাই পোড়াবে ওরা।
তাই করল। চোখের সামনে বাড়ির একটি অংশ কেরোসিন, পাটখড়ি আর বাবলা কাঠ দিয়ে জ্বালিয়ে দিল। ওইদিন ওদের উল্লাস দেখে খুব কষ্ট লেগেছিল।
গ্রামে আমার দাদা হাজি দেরাস উদ্দীন ছিলেন বয়োজৈষ্ঠ মানুষ এবং একমাত্র হজ্ব করা সম্মানিত ব্যক্তি। কিন্তু তার কথারও গুরুত্ব দেয়নি শান্তি কমিটির লোকেরা। তার ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে, এটিই ছিল অপরাধ।”
তিনি আরও বলেন, “ওইসময় রাজাকাররা প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসত। পাশেই একটি বড় ব্রিজ ছিল, আমরা বড় সাঁকো বলতাম। ওখানে তারা একটা ক্যাম্পও বসায়। তাদের মাধ্যমে দাদাকে মাঝেমধ্যেই ইপিআর ক্যাম্পে ডেকে নেওয়া হতো।
নানাভাবে হুমকি দিয়ে পাকিস্তানি সেনারা বলত, ছেলেকে ধরিয়ে দাও।
দাদা বলতেন, সে আসে না। কোথায় আছে তাও জানি না।
কিন্তু ওরা বিশ্বাস করত না। পাঞ্জাবি এক সুবেদার মেজরের নেতৃত্বে দাদাকে নানাভাবে ভয় দেখিয়ে মানসিক টর্চার করা হতো। তার কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ থাকত সবসময়। তাতে টাকা রাখত। প্রতিবারই ওরা পাঁচশ বা এক হাজার টাকা জোর করে রেখে দিত।
শেষের দিকে যখন বড় ভাইও ধরা পড়ল। আমরাও বাড়ি থেকে দূরে চলে গেলাম। তখন দাদা একাই বাড়িতে ছিলেন। বাড়ির দুই পাশে দুটি পুকুর পাড়ে রাজাকাররা বাঙ্কার করে। তারাও তখন দাদাকে মানসিক নির্যাতন করেছে। একপর্যায়ে তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত দাদা আর সুস্থ হতে পারেননি।”
স্বাধীনতা লাভের শেষ সময়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় কাশেমের ভাই মহিউদ্দিনকে। পরে তাকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইপিআর ক্যাম্পে নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানি সেনাদের গুলি মহিউদ্দিনের বাঁ চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার খুলি ভেদ করে বেরিয়ে যায়।
একাত্তরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইপিআর ক্যাম্পে ছিল পাকিস্তান সিভিল আর্মস ফোর্স নামে একটি বাহিনী। সেখানে মসলা বাটত একজন বাঙালি লোক, নাম আলাউদ্দিন। মূলত সে-ই পাকিস্তান আর্মিদের হেল্প করত মহিউদ্দিনদের মতো বাঙালি ধরে আনা ও হত্যায়। স্বাধীনতা লাভের দু-একদিন পর ওই রাজাকারকে ধরে আনে মুক্তিযোদ্ধারা। জুতার মালা গলায় দিয়ে পাঁচ গ্রাম ঘোরানো হয়। পরে সে জনরোষে পড়ে মারা যায়।
একাত্তরে ৩০ লাখ শহীদ, আড়াই লাখ নির্যাতিত মা-বোন এবং জাতির অসাধারণ ত্যাগের বিনিময়ে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। স্বাধীনতার পরপরই যুদ্ধাপরাধী, রাজাকারসহ পাকিস্তানপন্থি সকল বাহিনীর তালিকা চূড়ান্ত ও বিচার করা যুক্তিযুক্ত ছিল৷ কিন্তু সেটি করতে না পারার ব্যর্থতায় বাঙালি জাতিকে এখনও চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদর বিচার নিয়ে আগের মতো এখনও চলছে নানা রাজনৈতিক খেলা। ওই খেলা যতই ঘটুক না কেন, আমাদের শেকড়ের ইতিহাস একাত্তরে, ‘রাজাকার’ শব্দটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ঘৃণিত হয়েই থাকবে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ১২ এপ্রিল ২০২৫
© 2025, https:.