মুক্তিযুদ্ধ

মুক্তিযোদ্ধা থোপাল কড়া কোথায় ঠাঁই পাবেন

বীর মুক্তিযোদ্ধা থোপাল কড়া মারা গেছেন। মঙ্গলবার রাতে মুঠোফোনে খবরটি দেন দিনাজপুরের এক সাংবাদিক। মুক্তিযোদ্ধা হয়েও জীবদ্দশায় থোপাল কড়ার মেলেনি কোনো কাগুজে সনদ। ফলে তার নিথর দেহও পায়নি না কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মান। সমাধিতেও হয়তো পড়বে না কোনো ফুলেল শ্রদ্ধা। এতে থোপাল কড়ার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু যায় আসে না। কিন্তু স্বাধীন দেশে একজন মুক্তিযোদ্ধার এভাবে নিভৃতে চলে যাওয়া এবং তাকে সম্মান না জানানোর ব্যর্থতার দায় এই রাষ্ট্রও এড়াতে পারে না। মুক্তিযোদ্ধা হয়েও একজন বীরের এমন প্রস্থান আমাদের মাথা নত করে দেয়। বীরের দেশে বীরদের সম্মান জানাতে না পারার দায় আমরাও এড়াতে পারি না।

প্রায় এগারো বছর আগে প্রথম গিয়েছিলাম মুক্তিযোদ্ধা থোপাল কড়ার কাছে। দৈনিক সমকালের কালের খেয়ায় প্রকাশিত হয়েছিল তার বীরত্ব ও অভিমানের ইতিহাসটি। তার ও কড়া জাতির মানুষদের জীবনপ্রবাহ দেখেছি খুব কাছ থেকে, প্রায় আট বছর ধরে। একান্তভাবে মিশে জেনেছি এ জাতির সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য, সুখ-দুঃখ, আনন্দ ও সংগ্রামের কথাও। ফলে থোপাল কড়ার মৃত্যুর সংবাদে বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। কিছু করতে না পারার কষ্টে মনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে।

নিশ্চিহ্নপ্রায় কড়া জাতির একমাত্র গ্রামটি দিনাজপুরে, বিরল উপজেলার ঝিনাইকুড়িতে। প্রথম যখন যাই তখন গ্রামটি ছিল অন্যরকম। পাকা রাস্তা পার হতেই গ্রাম্যপথ। বেশ সরু ও ভাঙাচোরা রাস্তার দুদিকে তুঁতগাছের সারি। বিধ্বস্ত কিছু বাড়ি চোখে পড়ে রাস্তা থেকেই। কোনো এক এনজিওর দেওয়া একটি পাকা ল্যাট্রিন আর একটি টিউবওয়েলই গ্রামটিতে আধুনিকতার একমাত্র চিহ্ন। এভাবেই খুঁজে পাই মুক্তিযোদ্ধা থোপালের ‘কড়া’ গ্রামকে।

গোত্রের মাহাতো বা প্রধান জগেন কড়াকে সঙ্গে নিয়ে পা রাখি থোপাল কড়ার বাড়িতে। ভাঙাচোরা একটি মাটির ঘর থেকে বের হন তিনি। সঙ্গে তিন সন্তান রকি কড়া, সুমন কড়া আর মুক্তা কড়া। ২০০১ সালে থোপাল কড়ার পরিবারের সঙ্গে জমিজমা নিয়ে বিরোধ হয় স্থানীয় বাঙালিদের। এ দেশে থাকলে তাদের মেরে ফেলা হবেএমন হুমকিতে থোপালের ভাই-বোনরা সে সময় পালিয়ে যান ভারতের কুসমন্ডি থানার জামবাড়ি গ্রামে। কিন্তু নানা হুমকিতেও মুক্তিযোদ্ধা থোপাল দেশ ছাড়েননি। একইভাবে নিজের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় না দিতেই অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। তবু আমাদের অনুরোধে মলিন মুখে বলেন মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মৃতি।

বাবা পোকুয়া কড়া আর মা ফকনি কড়ার ছয় সন্তানের মধ্যে থোপাল কড়া ছিলেন দ্বিতীয়। রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে বড় ভাই গোপাল কড়ার সঙ্গে তিনিও দেশ স্বাধীন করার জন্য উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। গোপাল ও আরেক যুবক সাতান কড়া গোপনে আদিবাসীদের যুদ্ধে যাওয়ার প্রচারণা চালাতে থাকেন, কড়া ভাষায় সবাইকে বলতে থাকেন‘চালা দেশ স্বাধীন কারোওয়ে, সবইন মিলকে দেশ স্বাধীন কারোওয়ে’।

যুদ্ধ শুরুর পরপরই বড় ভাই গোপাল কড়া যুদ্ধে চলে যান। কিন্তু পরিবারের চাপে তখনো থোপাল যেতে পরেন না। এদিকে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে যেতে তার মন আনচান করতে থাকে। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে মার কাছে নানিবাড়ি বেড়াতে যাওয়ার নাম করে থোপাল পালিয়ে চলে যান মুক্তিযুদ্ধে। প্রথমে শিববাড়ী ইয়ুথ ক্যাম্পে ট্রেনিং নেন। ট্রেনিং শেষে সাত নম্বর সেক্টরের অধীনে কমান্ডার ইদ্রিস আলীর নেতৃত্বে হামজাপুর ক্যাম্প থেকে হিলিসহ নিকটবর্তী গ্রামগুলোকে শত্রুমুক্ত করার জন্য যুদ্ধ করেন।

মুক্তিযুদ্ধের নানা কাহিনী বলতে গিয়ে থোপাল কড়ার চোখ বারবার ভিজে যাচ্ছিল। দেশের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে কত দিন না খেয়ে কেটেছে, কতরাত কেটেছে ডোবার পানির মধ্যে, গোরস্থানে। যুদ্ধের সময়ে থোপাল সহযোদ্ধাদের মৃত্যুযন্ত্রণা দেখেছেন কাছ থেকে। সে সময় দূর থেকে হানাদার আর রাজাকার বাহিনীর অত্যাচারের কথা শুনে নিজের পরিবারের চিন্তায় থোপাল আঁতকে উঠতেন। সহযোদ্ধা খলিল, কবির, রফিক, নয়ন আর নুরু মিলে একটি গ্রামকে শত্রুমুক্ত করার কথা বলতে গিয়ে এ যোদ্ধা আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। যুদ্ধ শেষে এক দিন দিনাজপুর স্টেডিয়ামে অস্ত্র জমা দিয়ে থোপাল কড়া ফিরে আসেন নিজেদের সনাতন কৃষিকাজে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় আদিবাসী-বাঙালি একসঙ্গে যুদ্ধ করলেও স্বাধীনতার পরপরই সবকিছু বদলে যেতে থাকে। থোপাল কড়া আক্ষেপ করে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন হলো আর আমরা হয়ে গেলাম সংখ্যালঘু আদিবাসী সম্প্রদায়’। ভূমি নিয়ে চলে নানা ঘটনা। কিছুদিন আগেও এই গোত্রের অন্তু কড়াকে স্থানীয়দের হুমকির মুখে দেশ ছাড়তে হয়েছে। থোপাল বলেন স্বাধীনের পর এ দেশ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ‘হামে নাহি খোজেয়ে’।

ভ্যানগাড়ি চালিয়ে উপার্জন করতেন মুক্তিযোদ্ধা থোপাল কড়া। তিনি অসুস্থ ছিলেন দীর্ঘদিন। কিন্তু কেউ তার খোঁজও রাখেনি। নিদারুণ কষ্টে দিন কেটেছে তার। যেটুকু জমি আছে তা নিয়েও চলেছে মামলা। যে দেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন সেই স্বাধীন দেশ থেকে তাকেই ভারতে চলে যাওয়ার জন্য হুমকি দেওয়া হয়েছে প্রতিনিয়ত।

স্বাধীনতা লাভের পর যুদ্ধে অংশগ্রহণের যে কাগজপত্র তার ছিল তা দিয়ে পরে মুক্তিযোদ্ধা সনদ গ্রহণের নিয়ম, পদ্ধতি ও সুবিধা লাভের বিষয়টি ছিল তার কাছে অজানা। তাই সীমান্তবর্তী গ্রামে অযত্নে পড়ে থাকা কাগজগুলো একবার বন্যার পানিতে ভেসে যায়। শুধু মুক্তিযুদ্ধ আর বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকে থোপাল কড়ার মনে। স্বাধীন দেশে প্রতিটি দিনই তার কাটাতে হয়েছে জীবযাপন আর গোত্র টিকিয়ে রাখার যুদ্ধে। তার অকপট কথা‘যুদ্ধ করেছি দেশের জন্য, শুধু চাই স্বাধীন দেশে নিজের অধিকারটুকু নিয়ে বেঁচে থাকতে’।

কাগুজে সনদ না থাকায় কোনো জাতীয় দিবসেই থোপালের মতো মুক্তিযোদ্ধারা সম্মানিত হননি। মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছরে এ দেশে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো সম্পূর্ণ তালিকাও তৈরি হয়নি। অথচ অবাক আর লজ্জিত হতে হয় যখন দেখি কিছু ‘অমুক্তিযোদ্ধা’ আর ‘রাজাকার’ মুক্তিযোদ্ধা ভাতা নিচ্ছেন, পাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধার সম্মান! এ দেশে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বারবারই পরিবর্তিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা। সে সুযোগে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদপত্র পেয়েছে অমুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকাররাও। ফলে স্বাধীনতার পর নানা দলে বিভক্ত হয়ে পড়ছে জাতির সূর্য সন্তানরাও।

মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পরও থোপাল কড়ার মতো নিভৃত, বঞ্চিত, ত্যাগী ও অভিমানী মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে পাওয়া যায়। যাদের কোনো কাগুজে সনদ নেই। আছে শুধু দেশের জন্য বুকভরা ভালোবাসা। এমন যোদ্ধাদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব নিতে হবে। তা না হলে ইতিহাসের দায়মুক্তি ঘটবে না। কিন্তু বিদ্যমান নিয়মনীতির বেড়াজালে থোপাল কড়াদের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের কি ঠাঁই হবে মুক্তিযোদ্ধাদের সে তালিকায়? নাকি থোপালের মতোই কাগুজে সনদ পাওয়া না পাওয়ার দোলায় এক দিন নিভে যাবে একেকজন সূর্য সন্তানের জীবনপ্রদীপ। থোপাল কড়ার তো কাগুজে সনদ নেই, তাহলে তার জীবন ইতিহাস কোথায় লেখা হবে? একেকজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনের গদ্যই তো মুক্তিযুদ্ধের একেকটি ইতিহাস। সেই ইতিহাসে কি ঠাঁই হবে থোপাল কড়ার মতো মুক্তিযোদ্ধার জীবন ইতিহাস?

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৮ জুলাই ২০২১

© 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button