পাকিস্তানি আর্মি তখন রাউজান কলেজ মাঠে ক্যাম্প করেছে। আমি, হারুন আর সলিমুল্লাহ মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিই। রাতে ঘরে মাদুর বিছিয়ে ভাত খাচ্ছি। সামনে বসা মা আর বাবা। খাওয়া শেষে দেখি বাবার চোখে পানি। তাকে কাঁদতে দেখিনি কখনো। আমার হাত ধরে তিনি শুধু বললেন, ‘তুমি আমার একটামাত্র ছেলে। একটা কথা মনে রাখবা কোনো মানুষকে অন্যায়ভাবে মারবা না, অন্যায় করবা না। দেশের জন্য তোমাকে আল্লাহর হাতে সঁপে দিলাম।’ বাবাকে ছুঁয়ে আমিও ওয়াদা করেছিলাম। সেই ওয়াদা এখনো রক্ষা করে চলেছি। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার স্মৃতি এভাবেই তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু জাফর চৌধুরী।
তার বাবা নজমুল হুদা চৌধুরী চাকরি করতেন চট্টগ্রাম কোর্টে, অ্যাসিস্ট্যান্ট কালেক্টর ছিলেন। সাত নম্বর রাউজান ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও তিনি। বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে। ১৯৭১ সালে আবু জাফর ছিলেন রাউজান কলেজের ডিগ্রি পরীক্ষার্থী। ১৯৬৯ সালের আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন আবু জাফর। মিছিল-মিটিং করে তারা দাবি জানায় শেখ মুজিবের মুক্তির। পাশাপাশি কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কাছে তুলে ধরতেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি নানা বৈষম্যের বিষয়গুলো। ওই এলাকায় সত্তরের নির্বাচনে মুসলিম লীগের পক্ষে এমএনএ প্রার্থী ছিলেন যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী। সে সময় তার লোকরা গুডস হিলের বাড়িতে তুলে নিয়ে যায় আবু জাফরসহ কয়েকজনকে। হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তবুও জীবনকে বাজি রেখে তারা বঙ্গবন্ধু আর নৌকার পক্ষে কাজ করেছে। তার ভাষায়, ‘আমি তখন রাউজান কলেজের জিএস। ভিপি লোকমান হাকিম, নুরুল আমিন আর শাহজাহানসহ নিচতলায় অফিসে বসে আছি। হঠাৎ একটা লাল জিপে আসে সালাউদ্দিন কাদেরের ফুপাতো ভাই। সে আমাদের উঠিয়ে নিয়ে যায় গুডস হিলের বাড়িতে। তখন মুসলিম লীগ বিরোধীদের এভাবেই তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হতো। পাহাড়ের ওপরে বাড়িটি। ঢুকতেই বাঘের অবয়বে গেট। আমাদের নিয়ে আসার সংবাদে ভেতর থেকে হা হা হাসির শব্দ। মনে হচ্ছিল কোনো দৈত্য হাসছে। আমার কাছে এসে ফজলুল কাদের বলে, ‘হে ব্যাডা চৌধুরীর পোয়ারে বোয়া, তুই আমার এগেনিস্টে করো দোয়া।’ সবাইরে নানা কথা বলে হুমকি দেওয়া হয় প্রথম। লাস্টে বলেন, ‘তোদের একটা জিপ গাড়ি দিমু। তোরা আমার জন্য কাজ করবি।’ আমি বুদ্ধি করে বলি আগে বাড়ি গিয়ে বুঝি। মৃত্যুর হুমকিতেও তখন পিছপা হইনি। সত্তরের নির্বাচনে এমএনএ পদে ফজলুল কাদের চৌধুরীকে ৪০ হাজার ভোটে ডিফিট দিয়ে আওয়ামী লীগের অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদকে নির্বাচিত করেছিলাম।’
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ শুনতে আবু জাফররা যান ঢাকায়, রেসকোর্স ময়দানে। তার ভাষায়, ‘আমাদের দাবি ছিল ছয় দফা না হয় এক দফা। স্বায়ত্তশাসন না মানলে দেশ স্বাধীন করতে হবে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু আমাদের একমাত্র নেতৃত্ব। অপেক্ষায় ছিলাম কী বলেন নেতা। তিনি বললেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না… মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ…।’ ওই ভাষণই সবার মনে ঝড় তোলে। বঙ্গবন্ধুর ওই নির্দেশনা নিয়েই রাউজানে সংগ্রাম কমিটি গঠন করি। ২৫ মার্চ ঢাকায় আর্মি নামার খবরে আবু জাফররা প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। রাউজান স্কুলের মাঠে চলে যুবকদের ট্রেনিং। এর দায়িত্বে ছিলেন আমিনুর রহমান, আবদুল হাকিমসহ কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা ও বিডিআর সদস্য। ওই সময় ওই ট্রেনিং তাদের মনোবল বৃদ্ধি করেছিল। কিন্তু বাঁশের লাঠি দিয়ে তো সামরিক বাহিনীকে ঠেকানো যায় না। ১৩ এপ্রিল সকাল থেকে পাকিস্তানি সেনা রাউজানের দিকে আসতে থাকে।
আপনারা তখন কী করলেন? এই বীরের উত্তর : ‘বিএলএফ বা বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স নামে একটা সংগঠন হয়েছিল। শেখ ফজলুল হক মণি ছিলেন এর প্রধান। চট্টগ্রাম জেলা কমিটিতে ছিলেন এস এম ইউসুফ, এম এ মান্নান, স্বপন চৌধুরী প্রমুখ। রাউজানে বিএলএফ সদস্য ছিলেন তিনজন আমি, লোকমান হাকিম সিকদার, শওকত হাফেজ খান রুশদী। ১৩ এপ্রিলের পর এ সংগঠনের নেতারা একত্র হন রামগড়ে। তখন অনেকেই ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতে চলে গেলেও আমি চলে যাই রাঙ্গুনিয়ায়, বোনের বাড়িতে। সেখানে পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখি কাপ্তাইয়ের দিকে পাকিস্তানি সেনাদের ট্যাংক যাচ্ছে। মনে তখন ঝড় ওঠে। তখন রাজহাট হয়ে গোপনে ফিরি বাড়িতে। দাদির দেওয়া একটি সোনার হার আর কিছু শুকনো খাবার নিয়ে দুই বন্ধুসহ দেশের জন্য ঘর ছাড়ি।’ আবু জাফররা হেঁটে চলে যান ফটিকছড়ি বর্ডারে। সেখান থেকে দুর্গম পাহাড় ও নদীপথে ভারতের সাবরুম এলাকায়। এস এম ইউসুফের মাধ্যমে তিনি ট্রেনিংয়ের জন্য নাম লেখান। ৪৫ দিনের ট্রেনিং হয় আসামের লোহারবন হাফলং ক্যাম্পে। তারা ছিলেন বিএলএফের প্রথম ব্যাচের যোদ্ধা। পরে অস্ত্র দিয়ে তাদের আনা হয় উদয়পুরে, জঙ্গলের ভেতর একটা প্রাইমারি স্কুলে। যুদ্ধদিনের প্রসঙ্গ আসতেই এই মুক্তিযোদ্ধার চোখ দুটো ছলছল করে। অতঃপর নিজেকে সামলে তিনি বলতে থাকেন ‘৬ জুলাই ১৯৭১। ফেনীর বটতলী বাজার হয়ে আমরা ভেতরে ঢুকি। তখন তিন থানা মিলে ছিল একটা এলএমজি। প্রত্যেকের কাছে রাশিয়ার সেভেন টু টু রাইফেল আর দুটি করে গ্রেনেড। জয় বাংলা সেøাগান ছিল আমাদের একমাত্র প্রেরণা। ওই স্লোগানে রক্ত টলমল করত। নিজ এলাকায় আসাটা ছিল কঠিন। আশপাশের থানার সব মুক্তিযোদ্ধা একসঙ্গে আসি। পাহাড়ি পথ। জোঁকে ধরেছে অনেককে। পাহাড় থেকে পড়ে জখমও হন কয়েকজন। পানির জন্য কলাগাছের ছালও চিবিয়ে খেয়েছি একাত্তরে। এভাবে আমরা আসি ফটিকছড়িতে। এক এক থানা পাড় হই আর ওই থানার একেকটা দল রয়ে যায়। সীতাকুন্ডমীরেরসরাই, হাটহাজারীতে রেখে আসি দলগুলোকে। রাউজানে ছিলাম আমরা দশজন আমি, সালেহ আহমেদ, সীতাকুন্ডর হাবীব, ফটিকছড়ির দিদার, নোয়াখালীর নারায়ণ, ফরিদ প্রমুখ। আমাদের কমান্ড করতেন সালেহ আহমেদ। গেরিলা ছিলাম। নির্দেশ ছিল কিল করবা কিন্তু বেঁচে থাকতে হবে। যেখানে শত্রুকে মারবা, সেখান থেকে দুই মাইল দূরে লাশ ফেলে আসবা। সেভাবেই অপারেশন করি এক নম্বর সেক্টরের রাঙ্গুনিয়া, রাউজান ও ফটিকছড়ির বিভিন্ন এলাকায়।’ স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালো লাগা অনুভূতি জানতে চাই আমরা। উত্তরে এই যোদ্ধা বলেন, ‘যেদিন যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি হয়েছে সেদিন বুকের ভেতর থেকে যেন একটা কষ্টের পাথর নেমে গিয়েছে। আনন্দে মনটা ভরে গিয়েছিল। এখন মরেও শান্তি পাব।’
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২ ডিসেম্বর ২০২১
© 2021, https:.