বাবার ইচ্ছা ছিল তার প্রথম সন্তান যদি হয় মেয়ে তবে নাম রাখবেন ‘নিলু’, ছেলে হলে রাখবেন ‘চন্দন’। দশ ভাইবোনের মধ্যে আমি তৃতীয়। কিন্তু প্রথম ছেলে সন্তান। তাই বাবার ইচ্ছাতেই নাম রাখা হয় ‘চন্দন’। পুরো নাম কাজী জাকির হাসান চন্দন।
বাবা কাজী মকবুল হোসেন ছিলেন আর্টিস্ট। অল ইন্ডিয়া রেডিও কলকাতার স্টাফ আর্টিস্ট ছিলেন তিনি। একাধারে তিনি গায়ক, নাট্যকার, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার, অভিনেতাও ছিলেন। সহকারী পরিচালক হিসেবে প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে কাজ করেছেন ‘দেবদাস’ ও ‘মুক্তি’ ফিল্মে। বাবাকে দেখে ছোটবেলা থেকে আমারও ইচ্ছে, শিল্পী হব, নাটক লিখব ও ডিরেকশন দেব। কিন্তু আর্টিস্ট হয়েও বাবা তা চাইতেন না। কারণ তখন শিল্পীদের জীবন ছিল কষ্টের। টাকাকড়ি ছিল না। শিল্পীর জীবনটাই ছিল সাধনার। এখন তো দুই একটা নাটক লিখলে আর দু’চারটা চরিত্রে অভিনয় করলেই সবাই আর্টিস্ট হয়ে যায়। বাড়ি, গাড়ি, টাকা আরও কত কী! ব্যবসায়ী আর আটির্স্ট এখন আলাদাভাবে চেনার উপায় নেই!
শৈশব ও কৈশোরের নানা স্মৃতির কথা শুনছিলাম যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কাজী জাকির হাসান চন্দনের মুখে। তার গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র। ২৫ মার্চ রাতে আপনারা কোথায় ছিলেন? ‘দেশের অবস্থা তখন থমথমে। ২০ মার্চ অনেক কষ্টে ঢাকা থেকে পরিবারসহ চলে আসি কুড়িগ্রামে।’ জাকির হাসানের কাছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই স্বাধীনতার স্পষ্ট ঘোষণা। তার ভাষায়, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরই লড়াইয়ের জন্য মানসিকভাবে তৈরি হয়ে যাই। বুঝে যাই, সংগ্রাম করেই স্বাধীনতা আনতে হবে। ওই ভাষণের পর মুক্তিযোদ্ধাদের আর কোনো ঘোষণারই প্রয়োজন পড়েনি।’ ট্রেনিং প্রসঙ্গে তিনি বলেন ‘এপ্রিলের প্রথম দিককার কথা। চাচাতো ভাই রাজু, ভাতিজা মহিম আর আমি সিদ্ধান্ত নিই যুদ্ধে যাওয়ার। মায়ের আঁচল থেকে নিই ১২ আনা, রাজু আনে ১০ টাকা আর মহিম দেড় টাকা। এ নিয়েই আমরা চলে যাই ভূরুঙ্গামারীতে। পুলিশের বাঙালি সদস্যরা ভূরুঙ্গামারী কলেজে ট্রেনিং করাচ্ছিলেন। সেখানে ৪-৫ দিন ফিজিক্যাল ট্রেনিংয়ের পর আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় টাপুর হাট, কুচবিহারে। সেখান থেকে দার্জিলিংয়ের শিলিগুড়িতে, মূর্তি ক্যাম্পে। পরে ওই ক্যাম্পের নামকরণ করা হয়, ‘মুজিব ক্যাম্প’। আমাদের ১৫০ জনকে ট্রেনিং দেওয়া হয় ৬ সপ্তাহ। আমার এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নম্বর ছিল এফ/৩৩।’
জাকির হাসান যুদ্ধ করেন ছয় নম্বর সেক্টরের লালমনিরহাট সাব-সেক্টরে। ৪৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি কোম্পানির দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তাদের ক্যাম্প ছিল ভারতের গিতালদহ পুরনো রেলস্টেশনে। সীমান্ত পার হয়ে তারা অপারেশন করেন লালমনিরহাটের মোগলহাট, কাকিনা, গোরপম-ল, আদিতমারী, স্বর্ণামতি ব্রিজ, রতনাই ব্রিজ, বড় বাড়ি
প্রভৃতি এলাকায়। এক অপারেশনে এই মুক্তিযোদ্ধা মারাত্মকভাবে রক্তাক্ত হন। কীভাবে? স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন ‘আমরা ছিলাম ক্যাম্পে। ফুলবাড়ির গোরপম-ল এলাকা থেকে এক বৃদ্ধ এসে খবর দেয় সেখানে পাকিস্তানি আর্মিরা নিত্যদিন এসে নারীদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ক্যাপ্টেন উইলিয়াম নির্দেশ দিলেন সেখানে অপারেশন চালানোর। দুজন কোম্পানি কমান্ডারকে দায়িত্বও দেওয়া হলো। কিন্তু রেকি ভুল হওয়ায় তারা সফল হলেন না। ফলে অপারেশনের দায়িত্ব এসে পড়ে আমার ওপর।
ক্যাম্প থেকে দড়িবাস নামের একটি জায়গা পেরিয়ে শাখা নদী জারি-ধরলা পার হয়ে যেতে হয় গোরপম-ল এলাকায়। জারি-ধরলার কাচারটা ছিল বেশ উঁচুতে। সেখানে ছিল বিরাট এক পাকুড় গাছ। রেকির সময় আমরা দেখেছি ৮ থেকে ১০ জন পাকিস্তানি সেনা ওই গাছের নিচে রেস্ট নিচ্ছে। আমাদের পরনে ছিল সাধারণ পোশাক। ওরা যে আমাদের মার্ক করেছে, এটি আমরা বুঝতে পারিনি। ২ জুলাই ১৯৭১। ভেলায় করে নদী পার হয়ে এগুতে থাকি। রাত তখন ৩টা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। প্রচন্ড ঠান্ডা। পজিশন নিয়ে আছি। আমার কাছে এলএমজি। দুই সাইডে দুজন। ওদের হাতে রাইফেল। একটু উঁচুতে আমরা। রাস্তাটা নিচে। বিভিন্ন পয়েন্টে আমরা ওঁৎ পেতে থাকি। ভোর হয় হয়। টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছে। দূর থেকে দেখা গেল পাকিস্তানি সেনাদের টুপি আর রাইফেল। বুঝলাম ওরা আসছে। অপেক্ষায় থাকি রেঞ্জের ভেতর আসার।
ওরা এই দিক দিয়েই গ্রামের দিকে ঢুকবে, তাই আমরা অ্যামবুশ করে বসে আছি। কিন্তু আসলে নিজেরাই ছিলাম ওদের অ্যামবুশের ভেতরে। আমাদের আসার সমস্ত পথে ওরা মাইন পুঁতে রেখেছে। যা বুঝতেও পারিনি। মিরাকেল ব্যাপার হলো, পজিশন নেওয়া পর্যন্ত ওদের একটি মাইনও ফোটেনি। ওরা রেঞ্জের মধ্যে আসতেই ‘চার্জ’ বলে একটি গ্রেনেড থ্রো করলাম। অন্যরাও তিন দিক থেকে চার্জ করল। পাকিস্তানি সেনাদের দশজনই স্পট ডেড। পাশেই ছিল সহযোদ্ধা বন্ধু আকরাম হোসেন। উঁচু একটি জায়গায় সে মাইনের সুতা দেখতে পায়। পাশ থেকে সুতাটা হাতে নিয়ে সে বলে, জাকির, ‘মাইন’। আনন্দে তখন হুঁশ নেই আমার। এলএমজিটা বাম হাতে ধরা। লুঙ্গিটা নেংটির মতো পরে ‘কোথায় মাইন’, বলেই একটা লাফ দিয়েছি, অমনি বিস্ফোরণ!
ছিটকে পড়ে গেলাম। গরু জবাই করলে যেমন হয় তেমনিভাবে ডান পা থেকে রক্ত বের হয়ে ভেসে যাচ্ছিল। দেখলাম হাঁটুর নিচ থেকে পা উড়ে গেছে। গাছের শেকড়ের মতো রগগুলো বের হয়ে আছে। চিৎকার দিয়ে উঠলাম। ভূরুঙ্গামারীর আনিসুল, আকরাম, নীলফামারীর শহিদুলসহ সহযোদ্ধারা গামছা দিয়ে পা-টা বেঁধে দেয়। তারা ভেলায় করে প্রথম নিয়ে আসে ক্যাম্পে। পরে চিকিৎসার জন্য আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কুচবিহার জি এন হাসপাতালে। ওখানেই ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়। অতঃপর ব্যারাকপুরসহ বিভিন্ন হাসপাতাল হয়ে কিরকি মেডিকেল হাসপাতাল থেকে কৃত্রিম পা লাগিয়ে দেওয়া হয়। পা ছাড়াও সারা শরীরে ছিল স্পিন্টারের ক্ষত।’
স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালো লাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। উত্তরে এই বীর বলেন: ‘দেশ তো অনেক এগিয়েছে। প্রবৃদ্ধি অনেক বেড়েছে। আগে আমাদের অঞ্চলে মঙ্গা নামক অভাব ছিল। কই, এখন তো মঙ্গা নেই। এদেশের ছেলেমেয়েরা তাদের মেধার স্বাক্ষর রাখছে সারা পৃথিবীতে। এটা দেখলে মন ভরে যায়।’ স্বাধীনতা লাভের পর মুক্তিযোদ্ধা কাজী জাকির হাসান স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে যোগ দেন বাংলাদেশ বেতারে। ঢাকা বেতার নাট্যচর্চার ইতিকথা, বেতার নাটকের নিজস্ব আর্টিস্টদের জীবনী, সারা দেশের বেতার নাট্যশিল্পীদের জীবনী প্রভৃতিসহ তার ১৫টি বইয়ের মধ্যে ৫টিই গবেষণা গ্রন্থ। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ বেতারের মুখ্য পান্ডুলিপিকার। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা এখন প্রয়াত। কিন্তু তার বলা সব কথাই প্রজন্মের কাছে ইতিহাস হয়ে থাকবে। প্রজন্মের উদ্দেশেই তিনি বলে গেছেন শেষ কথাগুলো ‘তোমরা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জেনে নিয়ো। একাত্তরের বীরত্বের ইতিহাস বুকে ধারণ করো। আমাদের অসমাপ্ত কাজ তোমরাই শেষ করবে। তোমরা লাল-সবুজ পতাকার সম্মান সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়ো।’
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২৩ ডিসেম্বর ২০২১
© 2021, https:.