আদিবাসী

গোদাবাড়ির পাহানদের কথা

পাহান আদিবাসী শিশুরা

দিনাজপুরের সীমান্তঘেষে শালবনের ভেতর গোদাবাড়ি গ্রাম। আর এ গহীন শালবনের ভেতরই পাড়া করে বাস করছে নানা ভাষী আদিবাসীরা।
আমাদের গন্তব্য উত্তর গোদাবাড়ি গ্রাম। পাহানদের এ আদিবাসী গ্রামটিতে এসেছিলাম বছর চারেক আগে। এ গ্রামে ৩০টির মতো পাহান পরিবারের বাস। তাদের নানা কথা শুনেছিলাম গ্রামপ্রধান বা মন্ডল মাঠু পাহানের মুখে।
গ্রামে ঢুকেই প্রথমই পা রাখি মাঠু পাহানের বাড়িতে। বাড়ির ঘরগুলো ঠিক আগের মতোই আছে। মাটি আর ছনে ছাওয়া। মাঠুর নাম ধরে ডাকতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন তার বড় ছেলে হরিস পাহান। জানালেন মাঠু পাহান মারা গেছেন দু’বছর আগেই। বছর চারেক আগে আমাদের তোলা মাঠুর ছবিটিই এখন হারিসের কাছে তার বাবার একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন।
চারবছরে হরিসরা হারিয়েছেন মাঠু পাহানের মতো আরো চারজন বয়োবৃদ্ধকে। যারা জানতেন পাহানদের আদি রীতিনীতি ও আচার। জানতেন আদিবাসী ভাষা, মিথ ও উপকথা। সময়ের হাওয়ায় বদলে যাচ্ছে এর অনেকটাই। আদিবাসী সমাজ থেকে বয়োবৃদ্ধদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মূলত হারিয়ে যাচ্ছে আদিবাসীদের মৌখিক ভাষা, লোক কাহিনী আর আদি বিশ্বাসগুলো।
মাঠু পাহানের মৃত্যুর পর গ্রাম প্রধান হন মধ্য বয়সী নিমাই পাহান। আমাদের সংবাদ পেয়ে আসেন টেম্প পাহানও। বয়স ষাটের মতো। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি বলতে এখন তিনিই। গ্রামটি ঘুরতে ঘুরতে তার সঙ্গে চলে আলাপচারিতা।
মুন্ডাদের সঙ্গে আচারগত কিছু পার্থক্য থাকলেও পাহানরা নিজেদের ‘মুন্ডা পাহান’ হিসেবেই পরিচয় দিতেই পছন্দ করে। এদের সমাজে গোত্রভাগ রয়েছে। গোত্রগুলো বিভিন্ন পশু-পাখির নামে হয়ে থাকে। এদের একই গোত্রে বিয়ে নিষিদ্ধ। গোত্রগুলোর নাম জানতে চাইলে টেম্প হরহর বলতে থাকেন- তিংকী, দুরা, হেমব্রম, তোমগড়িয়া, কেরকাটা, বাঘোয়ার, সঘুয়ার, হরদুয়ার, সপুয়ার প্রভৃতি।

কালোমনি পাহান
কালোমনি পাহান

পাহানদের গ্রামগুলো পরিচালিত হয় এক একটি গ্রাম পরিষদের মাধ্যমে। মন্ডল ছাড়াও রয়েছে বারঘা ও পরানিক নামে দু’টি। বারঘা মন্ডলের পরামর্শে হুকুম করেন আর পরানিক তা সবাইকে জানিয়ে দেন। পাহানরা পদগুলো নির্ধারণ করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সকলের মতামতের ভিত্তিতে। এ নিয়ে এদের মধ্যে কোনো মতপার্থক্য তৈরি হয় না। এ গ্রামের বারঘা দলিল পাহান আর পরানিক বিষ্ণু পাহান। এরা নির্বাচিত হয়েছেন বছর খানিক আগে।
মনের চোখে মাঠু পাহানের মুখটি বারবার ভেসে উঠছিল। সনাতন হিন্দু ধর্মালম্বী হলেও তাকে কবর দেওয়া হয়েছে গ্রামের কাছেই। টেম্প পাহানের মুখে আমরা শুনি মৃত্যুর পর পাহানদের আচারগুলোর কথা।
পাহান আদিবাসীরা মৃতদেহকে গোসল করিয়ে বাঁশের মাচায় করে নিয়ে যায় কবরস্থানে। মৃতদেহ কবরে নামানোর পর সবাই তার জন্য সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করে। এরপর গোত্রের একজন বয়োবৃদ্ধকে মন্ত্র পড়ে কবরটিতে বন্ দিতে হয়। টেম্পর ভাষায় মন্ত্রটি- “বাড়ি থেকে বাহির হইলাম গুরু, ডাইন বান্ধ গুরু, বান্ধে স্বর্গে মানুষের, সেইজনের দোয়াতে বান্ধে রাখিতে হয়। ঢাক বাজে, কড়া বাজে সাজিয়া নিল ওকে। আমরা সোনার পালন্কে দিয়ে লেইকে যাইয়েই লা।” পাহানরা মৃত্যুর ১৩ দিনের দিন ‘ঘাটকামান’ আচার পালন করে। পরে আয়োজন করা হয় শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের।
মাটির দেওয়াল ঘেরা পায়রো পাহানের বাড়িতে ঢুকেই আমাদের চোখ কপালে ওঠে। উঠানে স্তুপ করে রাখা হয়েছে বাদামী রঙের গাছের শিকড় বিশেষ। এককোণে বসে সেগুলো কাটছেন পায়রো। বয়স পঞ্চাশের মতো। কি কাটছেন? প্রশ্ন করতেই পায়রোর উত্তর- ‘পেন্টি কান্দা (আলু)’।
সময়টা ছিল কার্তিক। পাহানরা মূলত কৃষি পেশার সঙ্গে যুক্ত। তাই ভাদ্র,আশ্বিন ও কার্তিক এই তিনমাস এদের ঘরে অভাবে থাকে। এ সময়টায় এদের কোনো কাজ থাকে না। ফলে খাবারের জন্য এরা এ সময় বন থেকে কুড়িয়ে আনে জংলি আলু। এদের ভাষায় ‘পেন্টি কান্দা’। পাহানরা বলে,‘জঙ্গলকার কান্দা খাইয়ে লা’।
পায়রো পাহান জানায় তারা বন থেকে দুই ধরণের আলু সংগ্রহ করে। ‘পেন্টি কান্দা’ সব সময় খাওয়া যায়। কিন্তু ‘গেঠি কান্দা’ তেতো হওয়ায় বিশেষ প্রক্রিয়ায় খাওয়ার উপযোগী করে নিতে হয়। এ প্রক্রিয়াটি বেশ কষ্টকর।
‘গেঠি কান্দা’ প্রথমে কেটে একদিন পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। পরদিন সেটি আবার পরিষ্কার ও সিদ্ধ করে পানি ফেলে দিতে হয়। অতঃপর শুকিয়ে প্রয়োজন মতো লবন ও হলুদ দিয়ে খেতে হয়। এই গেঠি কান্দা নিয়ে পাহানদের মধ্যে চালু রয়েছে কল্পিত গীত। পায়রোর ভাষায়, ‘মায়ে বেটি বোনে গেল, গেঠি কান্দা খড়ি লেল, বোঝা ভইর কাঠি বান্ধ’।
পাহান গ্রামের সবচেয়ে শিক্ষিত ছেলেটি সুখদেব পাহান। পড়ছে কালিয়াগঞ্জ এসসি উচ্চ বিদ্যালয়ে। নবম শ্রেণীতে। জন্ম থেকেই পক্ষাঘাতগ্রস্ত সে। দু’হাতের বুড়ো দ’ুটি আঙুল অকেজো। তবুও তার বাবা তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। তাই কষ্ট করে হলেও তাকে পড়াশুনা করাচ্ছেন। একদিন ছেলে বড় মানুষ হবে। পরিবার ও পাহান আদিবাসীদের মুখে হাসি ফোটাবে। এমনটাই বিশ্বাস বাবা খোকা পাহানের।
সুখদেবদের বাড়িতেই আমরা আসন গাড়ি। গ্রামের অনেকেই জড় হয় সেখানে।
পাহানরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে ‘নাগরি ভাষায়’। ভাষা বোঝাতে সুখদেব আমাদের সাহায্য করে। পাহানদের ভাষার লিখিত কোন বর্ণ নেই। সূর্যকে এরা ‘বেলা’, সকালকে ‘বিহান’, রাতকে ‘রাতি’, খরগোশকে ‘লাম্ভা’ বলে। তোমার নাম কি? বাক্যটিকে পাহানরা বলে- ‘তোর নাম কয়?’ তুমি কেমন আছ? বাক্যটিকে বলে- ‘তয় কিমন হিম?’
গোদাবাড়ি গ্রামের পাহানরা একসময় চিকিৎসার জন্য নির্ভর করত কবিরাজের ওপর। পাহান ভাষায় তাদের বলে ‘মাহান’। এই গ্রামের নামকরা মাহান ছিলেন কন্দুর পাহান। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে টেম্প এখন মাহানের কাজ করছেন। বিজ্ঞানের এই উৎকর্ষের যুগেও পাহানরা জ্বর ও মাথা ব্যাথা হলেই ছোটে টেম্পর কাছে। তিন ফুঁ’র জেরে তিনি মাথাব্যাথা ও জ্বর ভাল করে দেন। কীভাবে করেন? এমন প্রশ্নে টেম্প বলেন, ‘মাহানদের খারাপ কাজ করলে চলবে না। মিথ্যা কথা বলা যায় না। কারও অমঙ্গলের কথা চিন্তা করলেই আর এই শক্তি থাকবে না। সব কিছু করে ভগবান। আমরা মাধ্যম মাত্র।’
তিনি একদমে শোনান মাথা ব্যাথার মন্ত্রটি-
‘মাথার বিষ
কে জারে,গুরু জারে।
আধ কপালের বিষ
কে জারে, গুরু জারে।
গুরু গিয়া জারে
কুমরে কুমচিয়া দোহায়।’
এমন কি সাপে কাটা রোগীকেও টেম্প মন্ত্রবলে সুস্থ করে তোলেন। তাই সাপে কাটলে আশপাশের গ্রামের মানুষও খোঁজ করে টেম্প পাহানকে। কীভাবে করেন জানতে চাইলে টেম্প বলেন, ‘বিষ নামাতে নিমের ডাল লাগে। ডাল রোগীর সারাশরীরে স্পর্শ করে করে মন্ত্র পড়তে হয়। মন্ত্র পড়তে হবে তিন ধাপে। এক দমে। মন্ত্রে একটু হেরফের হলেই বিষ নামবে না। উল্টো রোগী মারা যাবে।’
প্রথম ধাপের মন্ত্রটি শুনি টেম্পর জবানিতে-
‘এখানে পুশকানি
চারখানি ঘা
তাতে ছিল পদ্মমারী পাত।
পদ্মকুমারি- বাপা মায়ে নাম থুলো- জয় বিষহরি
কান্দে গঙ্গা, কান্দে বিষহরি রায়
হর বিষ হর
নি ঝর ঝর
গরু হাঙ্গারে বিষ, নি ঝর ঝর।’
দ্বিতীয় ধাপে গানের মত করে দম নিয়ে মন্ত্র পড়তে হয়। ভাবতে হয় মন্ত্রবলে আকাশ থেকে ভগবানের শক্তি এসে চুলে পড়বে এভাবে চুল থেকে বিভিন্ন অঙ্গ হয়ে পায়ের পাতা দিয়ে মাটিকে বিষ নামিয়ে দিবে।
টেম্প পাহানের ভাষায়, ‘কেশ থাকি মুর (মাথা), মুর থাকি কাপাল (কপাল), কাপাল থাকি আইত (চোখ), আইত থাকি নাক, নাক থাকি মুখ, মুখ থাকি থুতলি, থুতলি থাকি ঘেচা (গলা), ঘেচা থাকি দাকনা (দুই কাধ), দাকনা থাকি ছাতি (বুক), ছাতি থাকি পাজরা, পাজরা থাকি পেট, পেট থাকি নেভি, নেভি থাকি ডান্ডা (কোমর), ডান্ডা থাকি জাং (রান), জাং থাকি ঠ্যাংলা (হাটু), ঠ্যাংলা থাকি তুমবা (হাঁটুর নিচের অংশ), তুমবা থাকি সুপলী (পায়ের গোড়ালি), সুপলী থাকি তারোয়া (পায়ের পাতা), তারোয়া থাকি আঙ্গরি (আঙ্গুল), আঙ্গরি থাকি নখ, নখ থাকি মাটি।’
অতঃপর তিনি চোখ বন্ধ করে মন্ত্রটি বলতে থাকেন-
“কেশাশে মার মার
উড়াইলাম বিষ,
মাথা শে মার মার
উড়াইলাম বিষ,
ঝিনঝির কা পাক ফেকে উড়াইব বিষ….”
শেষ ধাপে আরেকটি মন্ত্র পড়ার পরই শরীর থেকে সমস্ত বিষ নেমে গিয়ে রোগী উঠে বসবে। কি সেই মন্ত্র? টেম্প আবার চোখ বন্ধ করে দম নিয়ে পড়তে থাকেন-
“মাছরাঙ্গা মাছ খায়
ঝারিয়া ফেলে কাটা,
এক তাল দুই তাল
জারে বিষ স্বর্গে পাতালে….”
এরপর প্রসঙ্গ ওঠে পাহানদের শিকার নিয়ে। এবার কথা ফুটে গ্রাম প্রধান নিমাই পাহানের মুখে। পাহানরা এখনও দল বেধে শিকারে বের হয়। তিনদিন আগে এরা সকলেই বসে শিকারের পরিকল্পনা করে। পাহান নারীদের তখন ‘হাড়িয়া’ তৈরীর প্র¯ত্ততি নিতে বলা হয়। তাদের ভাষায়,“ হাড়ি রাখন, ধম আসি দিন নিকলো বই”।
এদের বিশ্বাস শিকারে বের হওয়ার আগেই শিকারি ভূতকে সন্তুষ্ট করতে পারলে অধিক শিকার মিলবে। তাই শিকারের পূর্বে গ্রামপুজার স্থানে এরা মাটিতে ও গাছে সিন্দুর দিয়ে শিকারী ভূতের কাছে মানত করে। এদের ভাষায় এটি ‘ধুমন উরায়ে’। এখনও পাহানদের  শিকারের একমাত্র অস্ত্র তীর -ধনুক। পাহানদের পছন্দের শিকারগুলোর মধ্যে আছে ‘মুসা’(বড় ইঁদুর), লারেয়া (গাছে থাকা এক ধরনের জšত্ত), চুটিয়া (ছোট ইদুর), ঘুগু, মায়না (ময়না), লাম্ভা (খরগোশ), কেরকেটা, পেঁচা, হকসা (বড় পাখি বিশেষ), দুনদু প্রভৃতি। তবে প্রাণীগুলোর প্রজনন সময়ে এরা শিকার করা থেকে বিরত থাকে।দিন শেষে শিকারে যা মিলে তা থেকে প্রথমে শিকারি ভূতকে দেয়া মানতের একটি শিকার বলি দেয়া হয়। অতঃপর শিকারগুলো গোটা গ্রামের পরিবারগুলোর মধ্যে সমহারে বন্টন করা হয়। এই সমবন্টন রীতির কারণেই শত দারিদ্র্যের মাঝেও যুগ যুগ ধরে টিকে আছে আদিবাসীরা। ওই রাতে চলে হাড়িয়া খাওয়া ও ঝুমুর নাচ।
হঠাৎ পাশের বাড়িতে মাদলের ছন্দ। নিমাই আমাদের সহুরাই পূজার নিমন্ত্রণ করে। কালিপূজার খুব প্রচলন নেই পাহানদের মধ্যে। এর পরদিনই পাহানদের সহুরাই উৎসব। তাই মাদলগুলো ঠিকঠাক করে নিচ্ছে তারা। নিমাইয়ের মুখে শুনি সহুরাইয়ের আদ্যোপান্ত।
সহুরাই পূজার দিন প্রতি বাড়ির গোয়াল ঘরসহ গোটা বাড়িটি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়। পূজার জন্য লাগবে লাল মোরগ। পাহানরা বলে- ‘কলানিয়া মুরগা লাগতই না হলে নে হোতো।’এছাড়াও পূজাতে লাগে ধুপ, তেলুয়া (তেলের পিঠা), সিন্দুর প্রভৃতি।
প্রথমে আতপ চালের গুড়ো করে গোয়াল ঘরের চারপাশের মেঝেতে সাজানো হয়। ওইদিন বিকেলে ভগবান বা সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে গোয়াল ঘরেই এরা মোরগটি বলি দেয়। বলি দেওয়ার দায়িত্বটি থাকে বাড়ির পুরুষের। অতঃপর মহিলারা গরুর পা ধুয়ে দেয়। শিং, মাথা ও শরীরে মেখে দেয় সরিষার তেল। গলায় পরিয়ে দেয় সোলার ফুল। গরুর শিং এ দেওয়া হয় সিঁদুর ফোটা। গরুটিকে পশ্চিমে রেখে পূর্বদিক থেকে তাকে ভক্তি দেয় বাড়ির নারীরা।
সন্ধ্যা হলে আতপ গুড়া পানিতে মাখিয়ে তা প্রদীপের আলোতে রেখে আবার গরুর শরীরে লাগিয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর গরুকে খেতে দেওয়া হয় হাড়িয়া পানি ও রান্না করা ভাত। গরুর খাওয়ার পরেই বাড়ির সবাইকে খেতে হয় গোয়াল ঘরে বসেই। ওই রাতে প্রতিটি গোয়াল ঘরে আলোসহ গোটা গ্রামটিকে প্রদীপ বা মোমের আলোতে আলোকিত রাখা হয়।
পাহানদের বিশ্বাস এ পূজার কারণে তাদের গবাদীপশুর রোগব্যাধি থেকে মুক্তি মিলে এবং বংশবৃদ্ধি ঘটে। পূজার রাতে পাহানরা সারারাত নাচগান আর হাড়িয়া খেয়ে আনন্দ করে। নিমাই থামতেই টেম্পর কন্ঠে সহুরাইয়ের গান। তার সঙ্গে কন্ঠ মিলায় আড়তি পাহান, তেতরি পাহান ও মহামতি পাহান। গানটি-
“খ-যাইতে খ-যাইতে আজই পুজাব
কেরে চুমায়ল গরুকা রে রে
কেরে পুজাইবে ধনুকা চারাইরে,
ফালনা বাবু ঘর আয়রে
জলতি ফালদি বিদায় দে,
মহারাণি বেটিয়া
নাই নিল তেলেকা সিন্দুয়ারে…. ”
সহুরাই ছাড়াও পাহানরা ধুমধামের সঙ্গে পালন করে কারমা উৎসবটি। এছাড়া এরা নতুন ধান ঘরে তোলার আগে নবান্ন উৎসব পালন করে। নবান্নকে এরাও বলে লবান। লবান নিয়ে আলাপ হয় খোকা পাহানের সঙ্গে।
লবানের দিন উপোস অবস্থায় সকালে বাড়ির পুরুষ (যে ধান কাটবে) একটি থালার মধ্যে সিন্দুর, পানসুপারি, কলা, ধুপ, প্রদীপ নিয়ে জমিতে যায়। অতঃপর ক্ষেতের পাশের একটি জায়গা লেপে পরিস্কার করে সেখানে কলা,পান সুপারি, প্রদীপ,ধুপ, সিন্দুর রেখে পানি ছিটিয়ে ভক্তি করে। ভক্তি শেষে প্রদীপটি তুলে ধান ক্ষেতে নেমে ৩টি গাছের আগাল (আগা) একত্রে মুঠো করে তার ওপর জ্বালানো প্রদীপটি রেখে এরা ধান কাটে। অতঃপর প্রদীপটি জমির পাশেই রেখে দেওয়া হয়।
ধান কেটে বাড়িতে এনে পাহানরা চাল তৈরী করে রান্না করে উপোস ভাঙে। একই সঙ্গে চলে হাড়িয়া খাওয়া। পরে সুবিধা মতো সময়ে গোত্রের সবাই শুকর বা খাসি জবাই করে সম্মিলিতভাবে পালন করে লবান উৎসব।
খোকা থামতেই টেম্প আবার গান ধরেন-
‘হামে লাগে প্রথমে আদিবাসীই
পনতা ভাত ভালোবাসি…’বৈশাখের রীতি অনুসারে প্রথমদিন পাহানরা ভাতের সঙ্গে খায় ১২ ভাজা অর্থাৎ ১২ পদের তরকারি। সকালে পানতা ভাত খায় সবাই মিলে। সন্ধ্যায় ঠাকুরকে ভক্তি দিয়ে এরা নাচগান করে।
বৈশাখের মতো চৈত্রের শেষদিনেও পাহানরা আয়োজন করে নানা আচারের। ওইদিন এরা বাড়িঘর পরিষ্কার করে একে অপরের গায়ে কাদা আর রঙ ছিটায়। পূর্বপুরুষদের রীতি অনুসারে যার গায়ে কাদা বা রঙ দেয়া হয় তাকেই খেতে দিতে হয় হাড়িয়া। পাহানদের বিশ্বাস এতে বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় হয়। চৈত্রের শেষদিন এবং বৈশাখের প্রথম দিনের এ উৎসবকে পাহানরা বলে ‘সিরুয়া বিসুয়া’।
এ ছাড়াও এরা চন্দ্র হিসেবে চৈত্রমাসেই আয়োজন করে চৈতালি পূজার। রোগ থেকে মুক্তি পেতে ঠাকুরের কৃপা লাভই এ পূজার উদ্দেশ্য। এ পূজায় আগের রাতে উপোস থেকে পরেরদিন দুপুরে পূজার প্রসাদ দিয়ে উপোস ভাঙাই নিয়ম।
মঈনকাঁটা বা বেল গাছের নিচে মাটির উঁচু ডিবি তৈরি করে, লাল নিশান আর ধূপ কাঠি টাঙিয়ে, পান-সুপারি, দুধ, কলা, দূর্বা ঘাস, বাতাসা, কদমফুল, সিঁদুর, হাড়িয়া দিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে ঠাকুরকে পূজা দেওয়া হয় চৈতালিপূজায়। একই সঙ্গে বলি দেওয়া হয় মানতের কবুতর, হাঁস কিংবা পাঁঠা। পূজা শেষে চলে খিচুরি খাওয়া। রাতভর চলে হাড়িয়া খাওয়া আর নাচগান।
গোদাবাড়ির আশপাশের গ্রামের আদিবাসীরা অনেকেই আজ ধর্মান্তরিত হয়েছেন। পূর্বপুরুষদের জাত-ধর্ম টিকে না থাকলেও তারা পেয়েছে অর্থনৈতিক মুক্তি, চিকিৎসা সেবা ও সন্তানের লেখাপড়ার নিশ্চয়তা। অথচ গোদাবাড়ির পাহানদের জীবন কাটছে নানা দুঃখ, কষ্ট আর অভাবের মাঝে। তবুও কেন ধর্মান্তরিত হচ্ছেন না, এমন প্রশ্নে সবার চোখেমুখে যেন বিস্ফোরণ ঘটে। কষ্টগুলো লুকিয়ে রেখে দৃঢ় কন্ঠে পাহানরা বলে-‘জাতি কেনে ধ্বংস করব, যেটায় আছি ওইটায় রহবে।’

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলানিউজ২৪.কম, ১৩ নভেম্বর ২০১৩

WARNING :
If anyone wants to share this content, please contact me. If any unauthorised use or reproduction of salekkhokon.me content for commercial purposes is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.

© 2013 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button