অসাম্প্রদায়িক বঙ্গবন্ধু
গোপালগঞ্জের ত্যাগী সমাজকর্মী চন্দ্র ঘোষের সঙ্গে জেলখানায় দেখা হয় বঙ্গবন্ধুর। গুরুতর অসুস্থ চন্দ্র ঘোষকে অপারেশনের জন্য বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি তখন তাকে দেখতে চাইলেন। বঙ্গবন্ধুও তাকে দেখতে গেলেন। চন্দ্র ঘোষ কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, “ভাই, এরা আমাকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে বদনাম দিল; শুধু এই আমার দুঃখ মরার সময়। কোনোদিন হিন্দু মুসলমানকে দুই চোখে দেখি নাই।” কথাগুলো শুনে সবার মতো বঙ্গবন্ধুর চোখেও পানি এসে গিয়েছিল। তখন তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, ‘চিন্তা করবেন না, আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ।’ অসমাপ্ত আত্মজীবনী তে লিপিবদ্ধ এমন ঘটনার মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রমাণ পাওয়া যায়।
পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েও বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে হিন্দুদের বিষয় বাদ রাখেননি। সে আমলে একদিকে হিন্দু মহাজন ও জমিদারদের অত্যাচারে বাংলার মুসলমানরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল, আর অন্যদিকে ইংরেজদের সঙ্গে অসহযোগিতার পথ ধরে মুসলমানরা পিছিয়ে পড়ছিল। পাশাপাশি হিন্দুরা মুসলমানদের প্রতি বৈরী ও ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করলেও তাদের মধ্যেই অনেকেই স্বাধীনতার জন্য ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই করে ফাঁসিতে যেতে বা কারাভোগ করতে দ্বিধা করেনি। এসব বাস্তবতার সব দিকই বঙ্গবন্ধু দেখার ও বোঝার চেষ্টা করতেন। যার প্রমাণ মেলে আত্মজীবনীর ২৩-২৪ পৃষ্ঠার লিখনীতে ‘এই সময় যদি এই সকল নিঃস্বার্থ (হিন্দু) স্বাধীনতা সংগ্রামী ও ত্যাগী পুরুষরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সাথে সাথে হিন্দু ও মুসলমানের মিলনের চেষ্টা করতেন এবং মুসলমানদের উপর যে অত্যাচার ও জুলুম হিন্দু জমিদার ও বেনিয়ারা করেছিল, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন, তাহলে তিক্ততা এত বাড়ত না।’
পাকিস্তানের পক্ষে সক্রিয় কর্মী হয়েও কীভাবে বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িক মানবতাবোধকে টিকিয়ে রেখেছিলেন তা জানা যায় তার আরেক লেখা থেকে। তিনি লিখেছেন (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ৩৬), ‘অখ- ভারতে যে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না এটা আমি মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতাম। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হিন্দু নেতারা ক্ষেপে গেছেন কেন? ভারতবর্ষেও মুসলমান থাকবে এবং পাকিস্তানেও হিন্দুরা থাকবে। সকলেই সমান অধিকার পাবে। পাকিস্তানের হিন্দুরাও স্বাধীন নাগরিক হিসাবে বাস করবে। ভারতবর্ষের মুসলমানরাও সমান অধিকার পাবে। পাকিস্তানের মুসলমানরা যেমন হিন্দুদের ভাই হিসাবে গ্রহণ করবে, ভারতবর্ষের হিন্দুরাও মুসলমানদের ভাই হিসাবে গ্রহণ করবে।’
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু যে কাজটি বিশেষভাবে করার চেষ্টা করতেন তা হলো পূর্ব বাংলা যাতে উপেক্ষিত না হয়। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বিশেষ করে সোহ্রাওয়ার্দী সাহেবকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন তিনি যেন বাংলার কথা বলেন। অবিভক্ত ভারতের কলকাতা এবং বিহারে দাঙ্গা হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু রাতদিন দাঙ্গাপীড়িত এলাকায় কাজ করেছেন। সাম্প্রদায়িক হানাহানির বিরুদ্ধেও তার অবস্থান ছিল পরিষ্কার। ১৯৬৪ সালে ঢাকার দাঙ্গা-পীড়িতদের ত্রাতা ছিলেন তিনি। তার রাজনৈতিক দর্শনেও এই বিভেদের, এই নরহত্যার কোনো স্থান ছিল না। অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ছাড়া একটি দেশের কল্যাণ সম্ভব নয় এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর মূল রাষ্ট্রদর্শন।
পাকিস্তান আমলে তৎকালীন কেন্দ্রীয় নেতাদের বিশেষ করে লিয়াকত আলী খানদের আচরণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু বুঝে ফেলেন, ‘আমরা প্রতারিত হয়েছি।’ কলকাতা থেকে স্থায়ীভাবে ঢাকায় ফিরে আসার আগে তার ভগ্নিপতি ও রাজনীতিক আবদুর রব সেরনিয়াবাতকে তাই বলেছিলেন‘আমরা যে স্বাধীনতা পেয়েছি তাতে পূর্ব বাংলার কোনো কল্যাণ হবে না। অতএব আমাদের আবার নতুন করে সংগ্রাম করতে হবে।’
সেই সংগ্রামের প্রবল ইচ্ছে নিয়েই তিনি ঢাকায় আসেন এবং ছাত্রলীগ গঠন করেন। এরপর ১৯৪৯ সালে গঠন করলেন ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’। ১৯৫৫ সালে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে গঠন করেছিলেন ‘আওয়ামী লীগ’। কিন্তু কেন এটি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু? কারণ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা কতটা ভয়াবহ হতে পারে তার তিক্ত অভিজ্ঞতাটি তার ছিল। এ কারণেই তিনি যথেষ্ট সর্তক হলেন এবং একটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হয়েই সুপরিকল্পিত সংগ্রাম শুরু করেন।
১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়কে যুক্ত করেছিলেন। তার সেই ইশতেহার মানুষ গ্রহণ করেছিল। এর ভিত্তিতেই স্বাধীনতা লাভ করি আমরা। পাকিস্তান আন্দোলন থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু একটি অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন। এ আদর্শকে তিনি সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন। পাকিস্তান আমলে ধর্মের নামে মানুষে মানুষে বিভেদ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি, মুক্তিযুদ্ধকালে ধর্মের নামে পাকিস্তানিদের গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের ঘটনাবলির প্রেক্ষাপট ও বাঙালির শাশ্বত অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শ, সমাজ সংস্কৃতি ঐতিহ্য তাকে বাংলাদেশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে দৃঢ়প্রত্যয়ী করেছিল।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়কে বলেছিলেন ‘আমি বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার একটা বীজ পুঁতে রেখে গেলাম।’ কোনো বাধা, মিথ্যা প্রচার ও সমালোচনা বঙ্গবন্ধুকে এই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭২ সালে দেশবাসীকে তিনি যে সংবিধান দেন, তা ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান। ১৯৭২-এ বঙ্গবন্ধুর নেতৃৃত্বে প্রণীত সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা সম্পর্কে বলা হয়েছে এভাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার (ঘ) কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার ওপর নিপীড়ন, বিলোপ করা হইবে।’ ওই সংবিধান গ্রহণের সময় সংসদে দেওয়া তার বক্তৃতায় তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না।’
কিন্তু ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। তিনি সংবিধানের চার মূলনীতি পাল্টে ফেলেন। ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের আত্মপরিচয় বিকৃত করা হয়। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সুযোগ করে দেন জিয়া। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ধর্মাশ্রয়ী দল, বিশেষ করে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতি করার বৈধতা দেওয়া হয়। এরপর আরেক স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্মের বিধান জারি করেন। সে সময় থেকেই সাম্প্রদায়িকতার আলোকে পাঠ্যপুস্তকের মৌলিক পরিবর্তন ঘটানো হয়।
পঞ্চদশ সংশোধনীর পর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরে আসে। কিন্তু ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়নি। এতে ধর্মীয় গ্রুপগুলো এর সুযোগ নিচ্ছে এবং অপব্যবহার করছে। আবার সংবিধানের প্রস্তাবনার আগে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থেকে যায়। এতে সংবিধানের মধ্যেই ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে সাংঘর্ষিক অবস্থা বিরাজ করছে। সেখানে একটি বিশেষ ধর্মকে প্রাধান্যও দেওয়া হয়েছে। ফলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন বৃদ্ধিসহ সাম্প্রদায়িক শক্তি ও জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটছে বলে মনে করেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। একইসঙ্গে সেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের প্রতিফলনও ঘটেনি বলে মনে করেন অনেকেই।
জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসংখ্য বক্তৃতায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতিকে মনে করিয়ে দিয়েছেন। জাতীয় সংসদের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু চারটি মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, ‘সাম্প্রদায়িকতার বীজ বাংলার মাটিতে আসতে পারবে না।’ তাই অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শ ও ধর্মনিরপেক্ষতার দিশারী বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণের উদ্যোগই হতে পারে তার প্রতি শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদন। আর সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকার চেষ্টাই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার দিকে জাতিকে এগিয়ে নেবে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১৭ মার্চ ২০২২ (বিশেষ সংখ্যায়)
© 2022, https:.